মতামত

দ্রব্যমূল্য ও সুশাসন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে, আমার প্রিয় শিক্ষক ড. সাখাওয়াত আলী খান সম্পাদনা পড়াতেন। রিপোর্টিং-এ অনেক ক্লিশে (বহু ব্যবহারে জীর্ণ) শব্দ বা বাক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলতেন এমন একটি হল দ্রব্যমূল্য। বাজারে জিনিসের বাড়তি দাম নিয়ে রিপোর্ট প্রসঙ্গে স্যারের কথা হলো এটি একটি ক্লিশে বিষয়ে পরিণত হয়েছে, কারণ বেশিরভাগ রিপোর্টই খুব সাদামাটা ধরনের।

Advertisement

সেই কবে এসব শুনেছি, তবে এখনো গণমাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়মিত খবর। রমজান মাসে তা আরো বেশি, কারণ এ মাসে চারদিকে শুধু ভোগের আওয়াজ। সাখাওয়াত স্যার বলতেন, সরকার দাম কমিয়ে পারবেনা, মানুষের আয় বাড়ানোটাই আসল কাজ। কথাটি প্রণিধানযোগ্য।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দশ বছরের শাসনামলে সরকারি চাকরিজীবীদের বিলাসী জীবন গড়ে দিয়েছেন তাদের বেতন ও নানাবিধ সুবিধা বহুগুণ বাড়িয়ে। সরকারি খাত যতটা চাকচিক্য হয়েছে, বেসরকারি খাত ততটাই পর্যুদস্ত হয়েছে। বেসরকারি দু’একটি পেশা ছাড়া প্রায় সব পেশাতেই স্থবিরতা, বেতন, ভাতা বাড়ছে না। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা বহুগুণ বাড়ায় তার প্রভাব পড়েছে বাজারেও। বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষ দেখছে, তাদের আয় বাড়েনা। একটা জিনিস কেবল তরতর করে বেড়ে চলেছে আর সেটা হলো দ্রব্যমূল্য।

দেশ এখন উচ্চপ্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে। মানুষের মাথাপিছু আয়ও ১৯০৯ ডলার। আমরা জানি এগুলো সবই গড় হিসাব। যার আয় বেড়েছে, তার আয় বাড়তিই ছিল। এখন আরো বেড়েছে। পত্রিকায় যখন খবর আসে এক মণ ধান বিক্রির টাকায় এক কেজি খাসির মাংসও কেনা যাচ্ছে না, তখন মাথাপিছু আয় বোঝা না গেলেও বোঝা যায় দ্রব্যমূল্য ইস্যুটা এদেশে কখনো ক্লিশে নয়।

Advertisement

মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশের প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁইছে, আর্থিক উন্নয়নের এমন হার স্বত্বেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশব্যাপী মানুষের বিরক্তি ও ক্রোধ আছে। বিদেশ থেকে বড় বড় মোটরগাড়ি, শৌখিন বস্ত্রাদি, খাদ্য, পানীয়, অতিশৌখিন বিলাসপণ্য যতই আসুক আর তার বিক্রি বাড়ুক, সাধারণের আলোচনায় দ্রব্যমূল্য বাড়ার বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে।

রমজান মাসে এসে পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক হয়। চাহিদার ঊধ্র্বগতির সাথে যোগানের লড়াইয়ে পর্যুদস্ত সাদারণ মানুষ। রমজানে দ্রব্যমূল্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় স্থিতিশীল রাখতে কড়া নজরদারি করা হবে বলে যত আশ্বাসই সরকার থেকে দেয়া হোক, শেষ পর্যন্ত তার কিছুই মানেন না ব্যবসায়ীরা। মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই প্রায় দ্বিগুণ দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে।

আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনাটি এমন যে, এখানে একজন ব্যবসায়ী কোন ধরনের স্বচ্ছতা মেনে চলেন না। তিনি কোন পণ্যটি কত টাকায় কিনে কত দামে বিক্রি করছেন তার কোন প্রকাশ নেই, কোন জবাবদিহিতা নেই। বাজার মনিটরিং-এর কত যে পদ্ধতি আছে, সরকারি সংস্থা আছে। কিন্তু কোনটিই এই স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের পণ্য ব্যবসার পুরো জগতটিই মজুতদার, মুনাফাখোর, ফটকাবাজ, চোরাচালানিদের দখলে। আবার এদের সাথেই রাজনীতির যোগাযোগ। ফলে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি সুশাসনের সাথে জড়িত। অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটের কারণে, সুশাসনের সংকটের কারণে একটি আধুনিক মূল্য সংযোজন আইন করেও আজ সাত বছর ধরে সরকার সংগ্রাম করছে সেটি বাস্তবায়নের জন্য।

Advertisement

দাপুটে, মারকুটে ব্যবসায়ীদের পেশিশক্তির কাছে সরকার বারবার পরাজিত হয়েছে ২০১২ সালের ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে। আর এবার শোনা যাচ্ছে নতুন বাজেটে প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন আইনে একটি হারের পরিবর্তে একাধিক হার হবে। এই আইন বাস্তবায়নে আর মাত্র দুই মাস সময় আছে। এসবই শাসন ব্যবস্থাপনার সংকট এবং এই সুযোগটিই গ্রহণ করে ব্যবসায়ীরা।

স্বাভাবিক সময়ে চাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্য তেল আর সবজি এবং রমজানে ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো ভোগ্যপণ্যের কারণে যাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত তারা হিমশিম খায়। কিন্তু এদেশে এমন একটি অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারী চক্র আছে যারা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি স্বত্ত্বেও এসব তোয়াক্কা না করে যত দাম হোক সেসব কিনে। প্রয়োজনে নষ্ট করে তারা। আর এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কখনো ভাটা পড়েনা।

বৈষম্যমূলক আয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থানগত কারণে ক্রয়ক্ষমতায় অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করে আর দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটতেই থাকে। এখানেই সুশাসনের প্রশ্ন। উঁচু দামে কেনার মানুষ আছে বলেই অস্বাভাবিক উঁচু দামকে নীতি নির্ধারকরা সাদরে গ্রহণ করতে পারেন না। অবৈধ উপাজর্নকারীদের প্রতি রাষ্ট্রের এই মৌন সমর্থন সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর।

মাথাপিছু আয় বাড়ার যে তত্ত্ব আমাদের সামনে উপস্থিত সেখানে শুধু একটি কথাই বলা যায় - ক্রয়ের সক্ষমতা সব পর্যায়ে সমানভাবে না বাড়লে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণের বাইরেই থাকবে সবসময়।

দুনিয়ার সব দেশে উৎসবে সরবরাহের ব্যাপকতায় দ্রব্যমূল্য কমে। বাংলাদেশে ঘটে ঠিক তার বিপরীত। মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের এই মানসিকতার পরিবর্তন নিকট ভবিষ্যতে দেখতে পাব বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত দেন যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর হলো পথে পথে চাঁদাবাজি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাত সবসময় গ্রহণযোগ্য নয়। তবে চাঁদাবাজির সংস্কৃতি আছে। রাজধানীর ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষুদ্র কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে চাঁদাবাজি তার পরিমাণই কয়েকশ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বাড়াতে বৃদ্ধিতে এসব বিনিয়োগ বিহীন উপার্জন অর্থনীতিকে কলুষিত করে যাচ্ছে বহু যুগ ধরে। এর রাশ টেনে ধরার কোন প্রচেষ্টা নেই, বরং উৎসাহিত করার আয়োজন সর্বত্র।

দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মধারায় যেসব সমস্যা দৃশ্যমান সেগুলো সুরাহার প্রচেষ্টা নিতে গেলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সততা ও দৃঢ়তা চাই। তাহলেই সুশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাজারে নজর দেয়া সম্ভব হবে, প্রশাসনও দক্ষতার সাথে বাজারে অসাধু তৎপরতা রুখতে পারবে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম