ক্ষতবিক্ষত যখন সারাবিশ্বের শান্ত নিরাপদতম দেশগুলিও, তখন দেশ জাতি ধর্মভেদে আজ আতঙ্কের কোটায় সবাই এক কাতারে। কোনো জনসমাবেশে এড়িয়ে চলা, এমনকি সবচেয়ে নিরাপদ স্থান উপসনালয়গুলিতে বিশেষ দিনে বিশেষভাবে ভর করবে আতংক!
Advertisement
একদিকে বাস্তব জীবনের সামাজিকতা উঠে যাচ্ছে রব, তায় ভার্চুয়াল সামাজিকতায় যেন আরো বিষবিদ্ধ হবার নীলনকশা! অন্যদিকে কথিত আছে রাসুল (সা.) ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, কিয়ামতের পূর্বে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ তৈরি করা হবে, কিন্তু সেগুলো হবে হেদায়েত শূন্য ।
এই ভবিষ্যতবাণীর সত্যতার নিদর্শন আমাদের দেশেও সুলভ । অতি সুদৃশ্য মসজিদ, মার্বেল পাথরের মেঝে, এসি , শীষমহলের মত ছাদ আর আলোকসজ্জা। অথচ নামাজের প্রথম কাতার পূর্ণ হয় নাই। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দেশ, মসজিদে দান ছত্রের কোনো অভাব হয় না। আজীবন ধরে চলে মসজিদের নির্মাণ কাজও। কোনো স্থানে একটা মসজিদ নির্মাণে চাঁদার খাতা নিয়ে বেড়িয়ে গেলে দানশীলের অভাব পড়েনা । সেই মসজিদ হয়, দ্রুত এসি সংযুক্ত হয়, গরম জলের ব্যবস্থা হিসেবে এখন গেইজারও দ্রুতই সংযুক্ত হয়।
এর পাশেই কখনো পড়ে থাকে দুস্থ জীর্ণ স্কুল, যার মাথায় ন্যূনতম ছাদটাও নেই। উল্লেখ্য, সাদকায়ে জারিয়া কিন্তু উভয়টিই! ধর্মপ্রাণেরা স্পর্শকাতর হবেন না, কারণ আমি আমাদের পবিত্র স্থানের সর্বোত্তম সাদকায়ে জারিয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতে চাইছি। কারণ বিশ্বে নগর পরিকল্পনা আর ব্যবস্থাপনার অন্যতম ব্যর্থ রূপ আমাদের প্রাণের রাজধানী ঢাকা। অপ্রতুল স্থানের এই শহরে ক্রমবর্ধমান যানবাহন আর চাকরীপ্রার্থী শহরমুখী মানুষের জন্য স্থায়ী অস্থায়ী স্থাপনার যেমন রাশ টানা অতি জরুরি তেমন জরুরি এসবের সর্বোত্তম ব্যবহার।
Advertisement
তাই আলোচনায় আলোকপাত করতে চাই মসজিদে নগরী ঢাকার প্রতি ২ কিলোমিটারে নির্মিত একটি মসজিদের দিকে। জাপানের দক্ষিণে আমার বসবাস। কিউশ্যু রিজিওনে প্রথম মসজিদটা ঠিক আমাদের শহরেই স্থাপিত হয়েছিল। কারণ জাপানের ৫ম স্থানীয় কিউশ্যু বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ফুকুওকা শহরেই অবস্থিত।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কমবেশি প্রায় ৩০টি মুসলিম দেশের শিক্ষার্থী পড়ে। তাদের এবাদতের সুবিধার্তেই এই মসজিদ নির্মিত হয়েছে,ধর্মীয় বর্ণবাদমুক্ত এই দেশে। সেই মসজিদ শুধু পাঞ্জেগানা, জুম্মা বা জানাজা নামাজে সীমাবদ্ধ না, বরং তাতে বিভিন্ন কম্যুনিটি কাজই চলে।
উল্লেখযোগ্য কাজগুলি নিম্নরূপঃ ১। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বয়সভেদে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয় এখানে। এই শিক্ষা বলতে আমাদের মত আরবি হরফ চেনা,হেফজ করা না। আররি শব্দের অর্থ, ব্যাকরণ, আচারসহ সব শিক্ষা যাতে একজন মুসলিম শিশু নিজেই কোরান কিতাবটা বুঝে পড়তে পারে, কেন কি অর্থে কোন পরিস্থিতিতে কোন আয়াত এসেছে এবং এর মর্ম অনুধাবন করে।
২। রাহী , শরণার্থী , প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রিতদের সাময়িক বাসস্থান। নিরন্নেরর খাবার ব্যবস্থা। শিক্ষা বৃত্তি ব্যতিরেকে নিজের খরচে আসা শিক্ষার্থীর বিপন্নতায় খাবার ব্যবস্থা। দলবেঁধে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বাজার-রান্নার ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে যাদের খণ্ডকালীন কাজ আছে তারা সিংহভাগ বহন করে। বা কারো অনুদানের টাকায় ব্যবস্থা করে। মসজিদ সামগ্রিক তত্ত্বাবধায়ন করে।
Advertisement
৩। সমগ্র রমজান মাসে সেহরি ইফ্তার ও রাতের খাবারের আয়োজন। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই , বিশেষ করে যারা একক, তারা বছরের এই সময় মসজিদেই আহার করেন। এর খরচ হিসেবে সেই শিক্ষার্থীরা মাসব্যাপি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশগ্রহণ করে এবং এই অংশগ্রহণও আয়ের উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। তবে অবশ্যই কেউ এর বেশি দিতেই পারেন। উল্লেখ্য, রমজান মাসে প্রতি কম্যুনিটি থেকেই নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত হন।
৪। বিয়ে পড়ানো , জানাজা থেকে শুরু করে ছোট খাটো অনুষ্ঠান এখানে আয়োজিত হয়। এবং এই ক্ষেত্রেও মসজিদ তার দানবাক্স বা অন্যান্য আয় থেকে অনুষ্ঠানের খরচের চাপ কিছুটা ভাগাভাগি করে, যা আয়োজকদের সামর্থ্যর সাথে ওঠা-মানা করে।
৫। সারাবছর স্থানীয়, অন্য বিভাগের, বিশ্বের সব দেশের ইসলামিক স্কলার এসে আলোচনা করে, সাওয়াল জবাব, তফসীর বয়ান করেন। এই আয়োজনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অমুসলিমরাও উপস্থিত থাকেন। তারা ইসলামের সংস্কৃতি, আদর্শ, মূল্যবোধ জানতে পারেন।
এছাড়া নিয়মিতই এসবের পরিচ্ছন্ন উন্নত সংস্কারমুক্ত আলোচনা হয়, যাতে তরুণ যুবা সবাই ইসলামের প্রকৃত বয়ান জানতে পারে। স্খলন, পাপাচার ও অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। ফলশ্রুতিতে গোটা পৃথিবী ব্যাপী মুসলমান এবং ইসলামের প্রতি যে নেতিবাচক ও ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অশুভ প্রচলন হয়েছে , তা অন্তত জাপানে প্রচলিত হতে পারেনি। আমরা সকল মুসলিম ধর্মীয় বিধিমোতাবেক পোশাক, আচার পালন করেই এখানে এখনো নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা এবং স্বস্তিতে চলাফেরা করি। যদিও এখন বিশ্বে শান্তির দেশ নিরাপদ দেশ বলে কারোই আর নিশ্চিন্তে থাকার উপায় নাই।
৬। দেশেও এখন অনেক ঘরে দাওয়া বা ইসলামিক আলোচনার প্রচলন হয়েছে। এখানে মসজিদেই, বিশেষ করে রমজান মাসে, ইতেকাফরত নারী পুরুষ তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে এতদসংশ্লিষ্ট আলোচনায় মূল্যবান সময় বা দিন কাটাতে পারেন।
৭। নিজেদের বেশতি পোশাক, গরম কাপড়, কোম্বল ইত্যাদি ধুয়ে পরিষ্কার করে প্যাকেটে ভরে সবাই নির্দিষ্ট স্থানে রেখে যান। কারো প্রয়োজন হলে কেউ নিজের মত নিয়ে যাবেন, না হলে নির্দিষ্ট সময়ে যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিধ্বস্ত দেশে কার্টন ভর্তি করে ত্রাণসামগ্রীর সাথে পাঠানো হবে।
পরিধেয় বা শীত বস্ত্র ছাড়াও অব্যবহার্য ঘরের কাজের জিনিস, শিশুদের খেলনা, বই, বেশতী ধর্মীয় বইও কেউ রেখে যান যা মসজিদে ব্যাবহৃত হয়। অন্যথা কারো প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে নিয়ে যান।
৮। বিপন্ন কারো কোনো সমস্যা , অর্থনৈতিক ( পড়ার খরচ, চিকিৎসার খরচ) থেকে শুরু সামাজিক বা বিভিন্ন বৈষয়িক বিপন্নতাতেও মসজিদটি সিঙ্গেল পয়েন্ট অব কন্টাক্ট হিসেবে কাজ করে।
এছাড়াও হঠাৎ কোনো জরুরি প্রয়োজনে, যেমন কারো গাড়ি বিকল হয়ে গেছে, কোথায় কার কাছে দ্রুত গাড়ি কেনা যাবে থেকে শুরু করে বাসা বদলানো, এসির কাজ করেন এমন কারো খোঁজ কি আছে বা বাচ্চার মুসলমানি কোথায় করানো যায়, সব।
অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের জীবনের কিছু গল্প সবাই জানে। এর মধ্যে একটি ছিল , কপর্দকহীন কলেজ ড্রপআউট স্টিভ খাবাবের জন্য ৭ মাইল হেঁটে প্রতি রবিবার হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন সপ্তাহে একদিন একটু পেট ভরে খেতে। কালে কালে সব ধর্মের উপসনালয়ে ক্ষুধার্তকে অন্নদান, বাস্তুহীনকে আবাস দেবার মত মানব সেবার প্রচলন আছে।
কোথাও গিয়ে কোনো মাথা গোজার ঠাঁই না পেলে স্থানীয় মসজিদে ঠাঁই নেয়া যাবে। আমাদের নায়করাজ রাজ্জাক থেকে ভারতের কিং খান শাহরুখ তারকা জগতে পা রাখার সংগ্রামের সময় এই উপসনালয়েই বহু রাত কাটিয়েছেন। স্রষ্টার ঘর কারো কাছেই এই সেবার বদল ঋণের দায় রাখে না। সব রাহে লিল্লাহ ।
জনসংখ্যার আর স্থাপনার ভারে ন্যুব্জ এই দেশের উপসনালয়গুলি এই রক্তাক্ত মুহূর্তে আজ যথাবিহিত মানব হিতৈষী হোক। নচেৎ, দানবাক্সর অর্থ অনুদান নিয়ে সিন্ডিকেট কেবল ভাগ বাটোয়ারায় নিমজ্জিত হলে কালে কালে জাতীয় কবির “মানুষ” কবিতাটি মসজিদের নগরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরবে .. ‘‘ তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!”
এইচআর/জেআইএম