আইন-আদালত

হাসপাতাল ১৪ হাজার, সেবার তালিকা মাত্র ১৫১টিতে!

উচ্চ আদালতের (হাইকোর্ট) এক নির্দেশনায় দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকা টানানো এবং জেলা সদর হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশনা এখনও মানা হয়নি। মূলতালিকা টানানোর বিষয়টি আদালতকে জানানো হয়নি।

Advertisement

হাইকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, রুল জারি ও স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা টানানোর নির্দেশনা দেয়ার পর দেশের বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে পর্যায়ক্রমে সাতটি জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতাল/প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের মালিক-পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ডাক্তারদের ফি (সার্ভিস চার্জ), স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা (ফি-চার্ট) রিসিপশন/পাবলিক প্লেসে ঝুলিয়ে রাখার জন্য বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট নয় হাজার ৫২৯টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও পাঁচ হাজার ৫৫টি রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতাল রয়েছে।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা মহানগরীতে ৫৭টি হাসপাতাল ও ৯৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকা (ফি-চার্ট) টানানো হয়েছে। তবে, এ মহানগরীতে ঠিক কতটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক বা হাসপাতাল আছে সে তথ্য জানা যায়নি। ঢাকা মহানগরীর বাইরে অন্য কোথাও মূল্যতালিকা টানানো নেই। এ হিসাবে মোট ১৪ হাজার ৫৮৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের মধ্যে ১৫১টিতে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা টানানো আছে।

এখনও নিরূপণ সম্ভব হয়নি জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপনে কত জনবল প্রয়োজন বা নিয়োগ দেয়া দরকার।

এ বিষয়ে গত ২৪ এপ্রিল আদালতে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলা হলেও আরও দুই মাস সময় চেয়ে আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু জাগো নিউজকে বলেন, দেশের সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ-সিসিইউ স্থাপন ও পরিচালনায় কত সংখ্যক লোক নিয়োগ দেয়া দরকার বা কত জনবল প্রয়োজন- এটা এখনও ঠিক করা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে জনবল পরিচালনা করতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ হবে তাও নিরূপণ করতে না পারায় আদালতে সর্বশেষ প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হয়নি।

‘আশা করছি মামলার পরবর্তী তারিখ অর্থাৎ ২১ মের মধ্যে দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা এবং জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপনের বিষয়ে অগ্রগতির তথ্য পাওয়া যাবে’- যোগ করেন তিনি।

Advertisement

এদিকে রিটকারী আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. বশির আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, দেশের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার/ক্লিনিক/হাসপাতালে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা পুনর্নির্ধারণ ও তা টানানো এবং দেশের সব জেলা সদরে ৩০ শয্যার আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপনে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছিল। তার কিছু কিছু বাস্তবায়নের কথা আদালতে জানানো হলেও পুরোপুরি বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ছে না।

এছাড়া আদালত মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতি যেসব নির্দেশনা দিয়েছিল তাও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল। সে বিষয়ে আদেশের জন্য ২৪ এপ্রিল দিন ধার্য থাকলেও ওই কমিটির পক্ষ থেকে দুই মাস সময় চাওয়া হয়। পরবর্তীতে আদালত ওই বিষয়ে শুনানি এবং আদেশের জন্য আগামী ২১ মে দিন ধার্য করেন।

এ প্রসঙ্গে রিটকারী আইনজীবী ড. বশির আহম্মেদ আরও বলেন, চিকিৎসাসেবার সঠিক মূল্যতালিকা নির্ধারণ এবং জেলা সদরে আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপন করলে প্রতিদিন কিছু লোক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইসিইউ ও সিসিইউ স্থাপনে টাকা বরাদ্দ দিতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করবেন না। আশা করি, প্রশাসনিক শত জটিলতার পরও এটি কার্যকর হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতাল/ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা আইন অনুসারে টানানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

পাশাপাশি ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২’ অনুসারে নীতিমালা তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ৬০ দিনের মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেন আদালত। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের যৌথবেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. বশির আহমেদ। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন সাজু ও মাসুদ হাসান চৌধুরী পরাগ। হিউম্যান রাইটস ল’ ইয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের পক্ষে কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলম রিটটি দায়ের করেন। রিটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে বিবাদী করা হয়।

রিট আবেদনে দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২-এর ১৪ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। ওই ধারায় বলা আছে—‘ডিজি হেলথ অথবা তার মনোনীত কোনো কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো আদালত এ অধ্যাদেশের অধীন কোনো অপরাধ আমলে নিতে পারবেন না।’

রিট আবেদনের ৩০ দিনের মধ্যে সব অনুমোদিত ও অননুমোদিত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যন্ত্রপাতিসহ তালিকা দাখিল, দেশের সব জেলা সদর হাসপাতালে ৩০ শয্যার আইসিইউ/সিসিইউ স্থাপন, মেয়াদহীন ওষুধ ব্যবহারে প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিএসটিআই অনুমোদিত ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

রিট শুনানি শেষে আদালতের নির্দেশনায় দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা নির্ধারণ করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের পরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিক সমিতির মহাসচিবকে রাখা হয়।

শুনানি নিয়ে আদালত দুই মাসের মধ্যে এ কমিটিকে ‘দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স- ১৯৮২’ অনুসারে চিকিৎসার ফি সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে নির্দেশ দেন।

গত ২৪ জুলাই দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকা আইন অনুসারে টানানোর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

এফএইচ/এমএমজেড/এমএআর/পিআর