জাতীয়

‘বিনামূল্যে পানির ধারণা ভেঙে দিয়েছে এডিবি-বিশ্বব্যাংক’

রাজধানীর জুরাইনে জন্ম রিফাতের। প্রায় ২০ বছর আগে ছোটবেলায় তিনি ওয়াসার ট্যাব থেকেই পানি খেতে পারতেন। এখন ওয়াসার পানির এতই বাজে অবস্থা যে, প্রায়ই সকালে কালো পানির জন্য গোসল করতে পারেন না তিনি।

Advertisement

রিফাত বলেন, ‘ওয়াসার পানিতে ময়লা থাকায় আমরা মসজিদ ও ডিপ টিউবওয়েল থেকে পানি এনে খেতাম। কিন্তু এখন পানি আনার মতো কেউ না থাকায় এক বছর ধরে আমরা ওয়াসার দূষিত পানি ফুটিয়ে খাই। আমার মায়ের কিডনির সমস্যা দেখা দিয়েছে, চিকিৎসা করাচ্ছি। আজ-কালের মধ্যে আমার বাবাকেও কিডনির ডাক্তার দেখাতে হবে।’

দীর্ঘদিন ওয়াসার দূষিত পানি পান ও ব্যবহারের কারণেই তার বাবা-মায়ের কিডনিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রিফাতের।

মঙ্গলবার (৭ মে) দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘নিরাপদ পানি: ওয়াসার দাবি ও জনগণের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক গণশুনানির আয়োজন করা হয়। সেখানেই ওয়াসার পানি ব্যবহারের অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে শোনান রিফাত। তার মতো অনেকেই তাদের ওয়াসার দূষিত পানির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

Advertisement

গণশুনানিতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির দাবিতে আন্দোলনকারী, গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদ, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ওয়াসার নিরাপদ পানি আন্দোলনের আয়োজনে এই গণশুনানির সঞ্চালনা করেন জুরাইনবাসী মিজানুর রহমান।

এ সময় সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে পানি বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। তাই ওয়াসার পানির পরিবর্তে নাগরিকরা যাতে পানি কিনে খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়, সেই চেষ্টা চলছে। তাই নিরাপদ পানির জন্য শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া সত্ত্বেও রাজধানীবাসী নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। পানি যতই দূষিত হবে, ততই সেসব কোম্পানির বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ সহজ হবে এবং তাদের ভালো ব্যবসাও হবে।

এ বিষয়ে ওয়াাসার নিরাপদ পানির আন্দোলনকারীদের একজন রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘নিরাপদ পানি বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে দেব, এই চিন্তা ভেঙে দিয়েছে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকগুলোর মতো ঋণদানকারী সংস্থা। আর তাদের প্রকল্প। ওয়াসার এমডিকে নিয়ে বিশাল গুণগান কারা গাইছে? এই এডিবি। আবার এডিবির তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য প্রচার করছেন ওয়াসার এমডি। যারা আমাদের এই পানিতে অনভ্যস্ত করে বোতলের পানিতে অভ্যস্ত করতে চায়, পানির বাণিজ্যিকীকরণ নিশ্চিত করতে চায়, তাদেরই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ওয়াসা। এজন্য তারা আমাদের নিরাপদ পানি দিতে ব্যর্থ হয়।’

শুনানিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। কোকাকোলা এখন কোক বিক্রির বদলে বাংলাদেশে পানি বিক্রির চিন্তা করছে। এসব কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করার পরও ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ হচ্ছে না। পরিকল্পিতভাবেই এগুলো করা হচ্ছে।

Advertisement

প্রকল্পের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এখন একটা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, মেঘনা নদী থেকে পানি আনা হবে। এতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তাতে অর্থ দেবে। এই এডিবি, বিশ্বব্যাংক যারা বাংলাদেশকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, সেই ঋণের যে নীতিমালা হয়েছে, যে পরিকল্পনা হয়েছে, এই পরিকল্পনা-নীতিমালা সম্পর্কে আপনারা একজনও কি আছেন, যারা জানেন সেখানে কী আছে? ওই দলিলপত্র কী আপনাদের দেখা আছে? ওই দলিলগুলো বাংলাদেশের মানুষ দেখে না। এই ঋণের টাকা আমাদের শোধ করতে হয়। আপনি সামনের বাজেটে দেখবেন, ঋণের সুদ বাবদ কত টাকা ব্যয় হয়। ঋণের সুদ বাবদ যে টাকা ব্যয় হয়, আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের চেয়ে বেশি। ওইসব সুদ, এসব ঋণের সুদ।’

আনু মুহম্মদ বলেন, ‘ওয়াসা যদি শতভাগ সুপেয় পানি দেয়, তাহলে তো মিজানের (জুরাইনের সুপেয় পানির আন্দোলনকারী) ভয়ে ওয়াসার কর্মকর্তাদের অফিস থেকে পালানোর কথা নয়। আপনাদের সুপেয় পানি তো আপনাদেরই খাওয়ানো হবে। শতভাগ সুপেয় পানি ওয়াসার এমডি যে দাবি করেছে, এটা ওয়াসার একক দাবি নয়।

অন্য কাদের দাবি তা তুলে ধরে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি নামের একটা কর্মসূচি শেষ হলো। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের একটি কর্মসূচি আছে। এজন্য সরকারি আমলাদের এফোর্ট দিতে হয়, বাংলাদেশের কোন খাতে কেমন অগ্রগতি হলো। সেই রিপোর্ট করার জন্য সবাই ব্যস্ত। সেই রিপোর্টের মধ্যে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, বাংলাদেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষ সুপেয় নিরাপদ পানি পান করেন। আপনারা ৯৮ ভাগের মধ্যে পড়েন না। আমরা কেউ ৯৮ ভাগের মধ্যে পড়ি না। আমরা ২ ভাগের মধ্যে আছি। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা ও উন্নয়ন এই ধরনের ডাটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’

শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদী যদি বিষাক্ত না হতো, তাহলে ঢাকা শহরের মানুষের অসুখ-বিসুখের শতকরা ৫০ ভাগ থাকত না বলেও মনে করেন আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, ‘ঘরে, হাতপাতালে, ক্লিনিকে গেলে যে অসুখ দেখি, এর একটা কারণ পানি, আরেকটা বাতাস। দূষিত বাতাসে বিশ্ব রেকর্ড করেছি, এখন দূষিত পানিতেও বিশ্ব রেকর্ড করার পথে। এই অবস্থা থাকার কারণে বাংলাদেশে অসুখ-বিসুখ হচ্ছে।’

ওয়াসার এমডিকে অসত্য বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং তার পদত্যাগের দাবিসহ গণশুনানি থেকে বেশকিছু দাবি তুলে ধরা হয়।

দাবিগুলো হলো- যেসব বাসাবাড়ি বা এলাকায় পানি নেই এবং নোংরা ময়লা পানি আসছে, সেসব বাড়ি এলাকায় দ্রুত নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। দূষিত পানির কারণে জুরাইন, শ্যামপুর, মুরাদপুর, দনিয়ায় এ পর্যন্ত যারা অসুবি-বিসুখের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পানি দূষিত হওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত যে বিল পরিশোধ করা হয়েছে, সেই অর্থ ফেরত দিতে হবে। ভবিষ্যতে সুপেয় পানি না পাওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসী বিল পরিশোধ করবে না। বছরের পর বছর কীভাবে নোংরা, দূষিত পানি সরবরাহ করল ওয়াসা, সেই বিষয় তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

গণশুনানিতে শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিল।

পিডি/এমবিআর/জেআইএম