মতামত

রাইড আছে রাইট নেই

আমরা যারা সংবাদ মাধ্যমে কাজ করি তারা প্রতিনিয়ত এতো এতো দুর্ঘটনার খবর পড়ি, লিখি বা জানি যে, কতো খবরই চাপা পড়ে যায়। কোনো মানুষের জীবন পাতার পুরো খরবটি হয়তো আর জানাই হয় না। একটি খবর এসে আগের খবরটিকে পুরনো করে দেয়। পাঠক, দর্শক বা শ্রোতাকে মনে করিয়ে না দিলে বেমালুম ভুলে থাকাটাই স্বাভাবিক।

Advertisement

এই যে, লাবণ্যের কথা কি কারো মনে আছে? মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে চড়ার সময় বেপরোয়া গতির কারণে যার প্রাণ গেলো। তাকে বহনকারী মোটরসাইকেল এবং যে কাভার্ড ভ্যানের সাথে ধাক্কা লেগে তিনি মারা যান, দুটোরই ছিল বেপরোয়া গতি। পুলিশ সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, ওই উবার মোটরবাইক চালকের বেপরোয়া গতির কারণে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় প্রথমে ছিটকে পড়েন লাবণ্য। পরে ওই ভ্যানটি চালিয়ে দেয়া হয় তার শরীরের ওপর। পুলিশ আরো বলছে, দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানে গেলে উবার কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো সহায়তা করেনি।

শুধুমাত্র লাবণ্য নন, গেলো কয়েক বছরে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। আসেনি সাধারণ যাত্রীদের জন্য স্বস্তিকর কোনো খবর। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে মোট ছয় লাখ ১৬ হাজার ৬৪১টি। গেলো বছরই হয়েছে এক লাখ চার হাজার ৫৪টি।

এই শহরে মানুষ মোটরসাইকেল বা অ্যাপ ভিত্তিক পরিবহনের ওপর আস্থা পেয়েছিল যখন গণপরিবহনগুলো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। আবার সিএনজি অটোরিক্সা বা ট্যাক্সিক্যাব গুলো কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলেছিল। সেখান থেকেই মানুষের কাছে অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষ করে যানজটের এই শহরে রাইড শেয়ারভিত্তিক মোটরসাইকেল নগরবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু সময় যতো গড়াচ্ছে সেটি যেন আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে।

Advertisement

অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের কারণেই বেড়েছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। এখন ঢাকায় উবার মটো, পাঠাও, ওভাই, ওবোন, সহজ, স্যাম, চলো, ইজিয়ার, পিকমি, আমার বাইক, সহজ রাইডার্স, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটোসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের দিকটি বিবেচনা করে এরাও হয়ে উঠেছে স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের। গেলো চার বছরে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই।

এখন মোটরসাইকেলের কারণে ঢাকা শহরে যেন চলায় দায়। রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতেও চলে মোটরসাইকেল। অনেকে মজা করে বলে থাকেন, ঢাকাকে এখন মোটরসাইকেলের শহর বললে ভুল হবে না। ভাড়া নিয়ে অভিযোগ, নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে না চাওয়ার অভিযোগ এমনকি যৌন হয়রানির অভিযোগও রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র টাকা আয়ের লক্ষ্যে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়া চালকদের অনুমতি দিচ্ছে। এসব চালকদের মধ্যে অনেকেই অদক্ষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক সেবন করে।

নারীদের বাইকে তুলে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অযথা ব্রেক করে। উল্টোপাল্টা পথ দিয়ে নিয়ে যেতে চায়। আরোহীদের জন্য দেয়া হয় নিম্মমানের হেলমেট। রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের পর মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। চালকের সঙ্গে যাত্রীরও হেলমেট না থাকলে মামলা দেওয়া হচ্ছে।

এ কারণে অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ার করা মোটরসাইকেল চালকরাও যাত্রা শুরুর সময় যাত্রীর জন্যও হেলমেট রাখছেন। তবে মামলা এড়াতে ব্যবহার করা যাত্রীর জন্য দেওয়া এ হেলমেট দিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। কারণ এই হেলমেট অত্যন্ত নিম্মমানের। রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’র অনুচ্ছেদ ক. রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পরিচালনার শর্তাবলী’র ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের ব্যবহৃত মোটরযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইনসিওরেন্স ও এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট ইত্যাদি হালনাগাদ থাকতে হবে।

Advertisement

কিন্তু যাছাই-বাচাই না থাকার কারণে অধিকাংশ চালকই ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্র। এমনকি ঠিকানাও ব্যবহার করে ভুয়া। যে কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটালেও খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। যেমনটি হয়েছিল লাবণ্যকে বহনকারী মোটরবাইক চালকের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৮৮ শতাংশেরই কোনো হেলমেট থাকে না বলে জানানো হয় গবেষণায়।

২০১৭ সালে রাজধানীতে ৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৫৩ জন নিহত হয়। গত বছরের আট মাসে ৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৭ জন মারা যায়। ইউনাইটেড ন্যাশনস ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপের করা মোটরসাইকেলের হেলমেট সমীক্ষা শীর্ষক এক গবেষণার তথ্য বলছে, মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহারে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা ৪২ শতাংশ।

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা বলছে, নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ২০২০ সালের মধ্যে নিম্মমানের হেলমেট ব্যবহারের কারণে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াতে পারে এক লাখ ৬৩ হাজার থেকে দুই লাখ ১৪ হাজারে। আর শুধু সঠিক মানের হেলমেট ব্যবহার করেই বাঁচানো সম্ভব ৬৯ থেকে ৯০ হাজার আরোহীকে।

এতো গেলো পরিসংখ্যানের কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা কোনো একটি ভালো দিয়ে শুরু করলে সেই ভালোটা ধরে রাখতে পারি না। দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ চালু হয় তখন সেটির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল। তারা বলেছিল, বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত রাইড শেয়ারিং অ্যাপ তাদের কর্মসংস্থানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। হুমকির মুখে পড়ছে জীবনযাত্রা। আমাদের দেশেও একসময় টেক্সি চালকরা আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু মানুষ ভালোবেসেই স্বস্তির আশায় বেছে নিয়েছিল অ্যাপ ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং। কিন্তু সেটিই এখন হয়ে উঠেছে ভয়ংকর। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত। এসব প্রতিষ্ঠান ও চালককে নিয়মের আওতায় আনতে হবে।

এখন দেখা যায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোটরবাইক দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রীর আশায়। অনেকে যাত্রীদের ডাকাডাকিও করে। কিন্তু নীতিমালার ক অনুচ্ছেদের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ড, অনুমোদিত পার্কিংয়ের জায়গা ছাড়া যাত্রী তোলার জন্য সড়কের যেখানে সেখানে গাড়ি রাখা যাবে না। তার মানে এরা তোড়াই কেয়ার করছে আইনকে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

যেনতেন ভাবে পার পেয়ে যাওয়া মানেই নিশ্চিত দুর্ঘটনা ডেকে আনা। পরিচিতজন ও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এমন এমন চালক মাঝে মাঝে পড়েন যাদের আচার-আচরণ থেকে শুরু করে কোথাও কোনো পেশাদারিত্বের প্রমাণ নেই। এসব বিষয়ে অভিযোগ করা হয়তো যায়, কিন্তু প্রথম প্রথম খুব প্রতিকার হলেও এখন তেমন একটা শোনা যায় না। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন রয়েছে কীভাবে রাইডের সংখ্যা বাড়িয়ে দু’পয়সা আয় করা যায়।

কোনো দুর্যোগ শুরু হওয়ার আগেই যদি প্রতিরোধ বা প্রতিকার করা না যায় তাহলে সেটি বাড়তেই থাকবে। যে স্বস্তির আশায় যাত্রীরা অ্যাপস ভিত্তিক রাইড শেয়ার বেছে নিয়েছিল সেটি যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে মনোযোগ দিতে হবে সেদিকে। দুর্ঘটনার পাশাপাশি হয়রানি রোধে নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা। শাস্তিও হতে হবে মনে রাখার মতো। তাহলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও সোজা পথে হাঁটবে। কারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার বা রাইট তাদের কারো নেই। একটি দুর্ঘটনার কান্না সারাজীবনেও থামে না।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ।

shantanu.reporter@gmail.com

এইচআর/এমকেএইচ