মতামত

তারেক রহমানও কি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন?

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপির চার এমপির শপথ নেয়া। আসলে শপথ নেয়াটা চমক ছিল না। তারা যে শেষ পর্যন্ত শপথ নেবেন, এটা সবাই জানতো। আমি নিজেও মাসখানেক আগে শপথ নেয়ার সম্ভাবনার কথা লিখেছিলাম। শপথ নেয়াটা চমক নয়। চমক হলো 'দলীয় সিদ্ধান্ত ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে' শপথ নেয়া।

Advertisement

৩০ ডিসেম্বরের পর থেকে রাজনীতিতে বিএনপিরর অবস্থান ছিল দক্ষিণ মেরুতে, ২৯ এপ্রিল ঝড়ো টার্নে তারা চলে গেলেন উত্তর মেরুতে। আসি আসি বলেও ঘূর্ণিঝড় ফণী এলো না। কিন্তু তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির চার এমপি রাজনীতিতে যে ঝড় তুললেন, তার প্রভাব থাকবে বহুদিন।

তারেক রহমানের নির্দেশে বিএনপির চার এমপির শপথের পর আমার এক বন্ধু বলছিলেন, শেষ পর্যন্ত কি তারেক রহমানও আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন? শুনে আমি একটু চমকে গেলাম। গত দশ বছরে গোটা বাংলাদেশটাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেকেই আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।

সরকার তো বটেই গোটা দেশ, দেশের রাজনীতি শেখ হাসিনার একক নিয়ন্ত্রণে। শুধু আওয়ামী লীগ নয়; ১৪ দল, মহাজোট; এমনকি ২০ দলীয় জোটের অনেক সিদ্ধান্তও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে শেখ হাসিনাই নেন বলে আমার ধারণা। তাই বলে তারেক রহমান আওয়ামী লীগপন্থি হয়ে গেলেন! বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস্য বলে কিছু নেই।

Advertisement

আমি রাজনীতিতে কিছুই বিশ্বাস করি না, খালি বিশ্বাস করি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজকের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ, বিএনপির জোট বাঁধা যতটা অবিশ্বাস্য, ৭৫এর আগে আওয়ামী লীগের সাথে জাসদের জোট বাঁধা তারচেয়ে বেশি অসম্ভব ছিল। জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের আঁতাত এখন যতটা অবাস্তব, ৯০এর আগে আওয়ামী লীগের জাতীয় পার্টির সমঝোতা ততটাই অকল্পনীয় ছিল। তাই ভবিষ্যতে যদি কখনো আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি জোট বাঁধে আমি অন্তত অবাক হবো না। তবে সেটা আপাতত ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক।

বিদ্যমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির, অন্তত তারেক রহমানের কোনো সমঝোতার সুযোগ নেই। কারণ তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা হয়তো তেমনটা করবেন না। তবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় তারেক রহমানের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। তারেক রহমানও সেটা জানেন। তাই সেই ভয়েই তারেক রহমান এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। অবশ্য কাগজে-কলমে তিনি নির্বাসিত নন, পলাতক। তো এই তারেক রহমানের আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা শূন্য বললেই চলে। তাই সেই বন্ধুর কাছে তার মন্তব্যের ব্যাখ্যা চাইলাম। তিনি যা বললেন, তা হয়তো সত্যি নয়, কিন্তু আপনি উড়িয়েও দিতে পারবেন না।

তিনি বললেন, ৩০ ডিসেম্বরের অবিশ্বাস্য নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ মনে প্রাণে চাইছিল বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের আট সাংসদ যেন সংসদে যোগ দেয়। কারণ মুখে যাই বলুক, আওয়ামী লীগ তো জানে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন কেমন হয়েছে। তাই নৈতিক বৈধতা না পেলেও কাগুজে বৈধতার জন্য সত্যিকারের বিরোধী এমপিদের সংসদে আনাটা দরকার ছিল। গণফোরামের দুই এমপিকে ম্যানেজ করা গেলেও বিএনপিকে কিছুতেই ম্যানেজ করা যাচ্ছিল না।

বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের এমপিদের চাপ দেয়া, লোভ দেখানো, ভয় দেখানোর অভিযোগ করা হচ্ছিল। জাহিদুর রহমান জাহিদ ২৫ এপ্রিল শপথ নেয়ার পর তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করে বিএনপি বুঝিয়ে দিয়েছিল শপথের বিপক্ষে দলীয় অবস্থানে তারা অনড়। ২৮ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সবাই শপথের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তারেক রহমান চেয়ে নেন। স্থায়ী কমিটির সবাই তো বটেই বিএনপির সাধারন নেতাকর্মীরাও শপথের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু ভয়ে হোক, লোভে হোক, চাপে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক; এমপিরা কিন্তু বরাবরই শপথের পক্ষে ছিলেন। তারা যে সেই শপথ তারেক রহমানের নির্দেশে নিতে পারবেন; এটা বোধহয় তারা স্বপ্নেও ভাবেননি।

Advertisement

বিএনপির চার এমপির শপথে উল্লাসের ঢেউ সরকারি মহলে। আর বিএনপি শিবিরে বিভ্রান্তি আর শোকের ছায়া। সেই বন্ধু এবার থামলেন। বললেন, তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে বিএনপির ৯৯ ভাগ নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ আর আওয়ামী লীগের ১০০ ভাগ নেতাকর্মী উল্লসিত। সেই বন্ধু এবার পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনিই বলুন তারেক রহমান যদি আওয়ামী লীগে যোগ না দেন বা আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা না করেন; তাহলে তার সিদ্ধান্তে বিএনপি অখুশী, আওয়ামী লীগ খুশী হয় কেন?

অকাট্য যুক্তি সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির সমঝোতা হতে পারে। কিন্তু সেই সমঝোতায় তারেক রহমানের থাকা অসম্ভব। তবুও ধরে নিচ্ছি, অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য সন্তান সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। কিন্তু শপথের সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে, এখনও সমঝোতা বা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো আলোচনা নেই। বরং এখন মনে হচ্ছে, কোনো সমঝোতা হয়নি।

তারেক রহমান যখন বুঝলেন, তিনি অনুমতি না দিলেও এরা শপথ নিয়ে নেবে; তখন মান ইজ্জত বাঁচাতে তাদের শপথ নিতে বলেছেন। এতে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, দলে তার নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র, দলে সবাই তার কথায় চলে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান দলের এমপিদের শপথ নেয়া বা না নেয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

তবে এমপিদের শপথের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির যে সম্ভাবনা ছিল, যথাযথ কৌশলের অভাবে সেটা হয়নি। তাহলে কোনো আশ্বাস ছাড়াই বিএনপির এমপিরা ব্যক্তিগত লাভের আশায় সংসদে চলে গেলেন, তা দলের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এমনিতে তাদের সংসদে যোগ দেয়াটা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক। আমরা সবসময় চাই, সংসদ প্রাণবন্ত হোক, সবাই অংশগ্রহণ করুক। তবে বিএনপি যেভাবে অ্যাবাউট টার্ন করে সংসদে গেল তা তাদের জন্য ক্ষতিকর।

চার মাস ধরে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান, সংসদ অবৈধ, সরকার অবৈধ, শপথ নিলে বেঈমান বলে আসছিলেন; তাতে হঠাৎ এমন ডিগবাজিতে বোঝা যায়, আসলে এই দলের আদর্শিক দৃঢ়তা নেই, নৈতিক জোর নেই। চার এমপির শপথে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির যতটা ক্ষতি হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রক্রিয়ায়। তারেক রহমান লন্ডন থেকে সরাসরি এমপিদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। অথচ তখনও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভি আহমেদ তখনও তাদের বহিষ্কারের হুমকি দিচ্ছিলেন।

বলছিলেন, সরকার শপথের জন্য চাপ দিচ্ছে। তার কথা সত্যি হলে, চাপটা আসলে দেয়া হয়েছে তারেক রহমানকে। শপথের ঘণ্টাতিনেক পরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফেস সেভিং ব্রিফিং করে তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তকে দলীয় সিদ্ধান্তের আবরণ দিলেন, বৈধতা দিলেন। ব্যাকডেটে বিয়ের মত। সেই ব্রিফিঙে তার পাশে কেউ ছিলেন না। আমি তো ভেবেছিলাম, মির্জা ফখরুল পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন। ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধ থাকলে তার তাই করা উচিত ছিল।

মির্জা ফখরুল নিশ্চয়ই সেদিন ফিল করেছেন, দলে তার পদ মহাসচিব হলেও, আসলে তিনি রাবার স্ট্যাম্পও না। সেটা হলেও তাকে অন্তত আগে জানানো হতো। শুধু মহাসচিব বা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শুধু নন; আসলে বিএনপির কেউই কিছু জানতেন না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, তাদের কেন শপথের সিদ্ধান্ত আগে জানানো হয়নি। শুনে আমার হাসি পেয়েছে। মহাসচিব নিজেই যেখানে পরে জেনেছেন, সেখানে তাদের জানাবেন কিভাবে। নিজে শপথ না নিয়ে মির্জা ফখরুল নিজের ইজ্জত কিছুটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।

তারেক রহমান এমনভাবে সিদ্ধান্তটি জানিয়েছেন, যেন বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ওনার পৈতৃক সম্পত্তি। আসলেই বিএনপি তারেক রহমানের পিতার প্রতিষ্ঠিত, মায়ের গড়া সম্পত্তি। কিন্তু বাপ মায়ের সম্পত্তির প্রতিও সন্তানের কিছুটা মায়া থাকে। এখানে সেই মায়াটা দেখা যায়নি। দলের সবাইকে অন্ধকারে রেখে, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে, বিএনপির লাখো নেতা-কর্মী-সমর্থকের আবেগকে পায়ে দলে এককভাবে শপথের সিদ্ধান্তে দলের প্রতি মায়াটা অনুপস্থিত ছিল।

সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যদি নিতেই হয়, তাহলে সেটা আরো কিছুদিন আগে থেকে ধীরে ধীরে নেতা-কর্মীদের গা সওয়া করে নেয়া যেতো। নিদেনপক্ষে ২৯ এপ্রিল বিকেলে যদি তারেক রহমান হারুনুর রশিদকে ফোন না করে মির্জা ফখরুলকে ফোন করতেন; তাহলে সেটা শোভন হতো। মির্জা ফখরুল স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা ডাকতে পারতেন। সে সভায় সাংসদরাও উপস্থিত থাকতে পারতেন। সেখানে তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত জানিয়ে কমিটির অনুমোদন নিতে পারতেন।

তারপর মির্জা ফখরুল রাতে যে ব্রিফটা করেছেন, সেটা বিকালেই করতে পারতেন। তারপর চার এমপি একসাথে গুলশান অফিস থেকে রওয়ানা দিয়ে জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে সংসদে শপথ নিতে পারতেন। এতে বড় জোর একঘণ্টা সময় বেশি লাগতো। একই সিদ্ধান্ত, কিন্তু এমনভাবে বাস্তবায়ন করলে সেটা রাজনৈতিক দলসুলভ হতো; বাপের সম্পত্তিসুলভ মনে হতো না। কিন্তু আমার মনে হয়, তারেক রহমান ইচ্ছা করেই এটা করেছেন। তিনি আসলে সবার কাছে একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন, স্থায়ী কমিটি বা মহাসচিব-টচিব বলে কোনো লাভ নেই। বিএনপিতে আমি যা বলবো, তাই হবে।

বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা তৈরি করতে চাই শক্তিশালী সংগঠন। বিএনপির এখনও জনপ্রিয়তা আছে, কিন্তু সে জনপ্রিয়তাকে রাজপথে নামানো বা ভোটের বাক্স পর্যন্ত টেনে নেয়ার মত সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। সর্বশেষ যে স্টাইলে শপথ নেয়া হলো, তা বিএনপি নেতাকর্মীদের মনোবল আরো কমিয়ে দেবে।

এরই মধ্যে দল এবং জোটে কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গেছে। দলের অনেকেই প্রকাশ্যে তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। যারা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না, তারাও অপ্রকাশ্যে যা বলছেন; তার ছিটেফোটা শুনলেও তারেক রহমান বিএনপি ছেড়ে দিতেন।

আহারে বিএনপির জন্য আমার মায়াই লাগছে। দফায় দফায় লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা, এমন জনপ্রিয় একটি দলের এমন করুণ দশা ভাবাই যায় না।

এইচআর/এমকেএইচ