বিশেষ প্রতিবেদন

এমপি হওয়ার তিন দশক পর মুক্তিযোদ্ধা হন হাওলাদার!

>> ২০১৪ সালের আগে ছিল না কোনো ঋণ, পরবর্তীতে নেন ১৮৯ কোটি>> ২০০৮ সালে ছিল না কোনো গাড়ি, এখন ল্যান্ড ক্রুজারসহ চারটি গাড়ি >> স্ত্রী ব্যবহার করেন প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি ল্যান্ড ক্রুজার>> ২০০৮ সালে ছিল ২৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ, এখন তা ৩৭ কোটি

Advertisement

তখনও তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাকেরগঞ্জ-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম ওঠেনি হাওলাদারের। এরপর আরও কয়েকবার সংসদ সদস্য হলেও হাওলাদার নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেননি বা তালিকায় নাম তোলেননি।

আরও পড়ুন > এক ভুলে গচ্চা ৩০০ কোটি!

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায়ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না রুহুল আমিন হাওলাদার। তবে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেখা যায়, রুহুল আমিন হাওলাদার একজন মুক্তিযোদ্ধা। এজন্য তিনি ভাতা পান। ভাতা বাবদ তার বছরে আয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ রুহুল আমিন হাওলাদার যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তা এ দেশের মানুষ জানতে পারল তিনি প্রথম সংসদ সদস্য হওয়ার প্রায় তিন দশক পর!

Advertisement

গত রোববার (২৮ এপ্রিল) অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে মুক্তিযোদ্ধা হাওলাদারকে দেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলবি নোটিশের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে কোনো বাধা রইল না দুদকের। এ আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ।

২০০৮ সালের হলফনামা থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে ঢাকা সিএমএম কোর্টে হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনের ২ এর ৫ (২) নম্বর ধারায় মামলা হয়। অর্থাৎ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হলে গদি থেকে নামতে হয় হাওলাদারকেও। এরপরই ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের একই ধারায় হাওলাদারের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালে আরও চারটি মামলা হয়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও ওই পাঁচ মামলাসহ তার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলা চলমান ছিল। ওই নির্বাচনে তিনি জয়লাভও করেন। এরপর ২০১৩ সালের শেষ দিকে তিনি যখন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামা জমা দেন, ততদিনে তিনটি মামলা থেকে অব্যাহতি পান হাওলাদার। তার বিরুদ্ধে তখন চলমান ছিল দুর্নীতির অভিযোগে তিনটি মামলা।

আরও পড়ুন > ‘বড় বাবুর’ ৫ কোটি টাকার বাড়ি

Advertisement

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে জানা যায়, ওই তিন মামলা বর্তমানেও চলমান রয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও ঋণখেলাপির দায়ে রুহুল আমিন হাওলাদারের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ তিনি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছেন না। একাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেয়া হলফনামায় বলা হয়েছে, কয়েকটি ব্যাংক থেকে তিনি নিয়েছেন ১৮৯ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার ১৮৯ টাকা। তবে ২০১৪ সালের আগে তার ওই ঋণ ছিল না বলে দশম ও নবম হলফনামা থেকে জানা যায়।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে প্রার্থীদের হলফনামা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। নবম হলফনামায় দেখা যায়, ২০০৮ সালেও হাওলাদারের কোনো গাড়ি ছিল না। তার স্ত্রীরও ছিল না গাড়ি। ১০ বছরের ব্যবধানে একাদশ হলফনামার তথ্য মতে, হাওলাদারের ল্যান্ড ক্রুজারসহ প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা মূল্যের চারটি গাড়ি হয়েছে। তার স্ত্রী ব্যবহার করেন প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি ল্যান্ড ক্রুজার।

নবম ও দশম হলফনামায় হাওলাদারের ব্যবসা হিসেবে বাড়ি ভাড়া দেখানো হয়। তবে একাদশ হলফনামায় দেখা যায়, বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি তার শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানতের ব্যবসাও রয়েছে।

আরও পড়ুন > ১৫ বছরে ১৬টি জাহাজের মালিক হাসপাতালের কর্মচারী!

নবম হলফনামার তথ্য মতে, হাওলাদারের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি থেকে বছরে আসত পাঁচ হাজার ৮৪০ টাকা এবং বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া থেকে আসত ১৩ লাখ ৮ হাজার ৯৩৮ টাকা। একাদশ হলফনামার তথ্য মতে, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকানের পরিমাণ খুব একটা না বাড়লেও এসব থেকে বছরে ভাড়া আসে দুই কোটি ১১ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে এখন আর কোনো আয় আসে না।

সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে তিনি বছরে পেতেন ২৩ লাখ ৬ হাজার ৪৫০ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পান বছরে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে শেয়ার/সঞ্চয়পত্র/আমানত থেকে ব্যাংক সুদ আসে বছরে ১১ লাখ ৬৯ হাজার ২৩২ টাকা।

২০০৮ সালে যা ছিল

২০০৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৬৯ হাজার ৬৬ টাকা। যেসব সম্পদের অর্জনকালীন মূল্য উল্লেখ করা হয়নি, সেসব সম্পদ বাদ পড়েছে। এর মধ্যে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৪ লাখ ৮ হাজার ৯২৮ টাকা। অস্থাবর সম্পদগুলোর মধ্যে নগদ অর্থ ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯২৮ টাকা, আড়াই লাখ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী, দুই লাখ টাকার আসবাবপত্র এবং এক লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যে পাঁচটি অগ্নেয়াস্ত্র।

স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে তার নিজ নামে ছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩০ কাঠা জমি, গুলশান ও বাকেরগঞ্জে বাড়িসহ ১৫৮ দশমিক ৯২ শতাংশ জমি এবং এক কোটি ৭৬ লাখ ৬০ হাজার ১৩৮ টাকা মূল্যে গুলশান ও বাকেরগঞ্জে বাড়ি।

২০১৮ সালে যা হয়েছে

২০১৮ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ৫১ হাজার ৮৫৭ টাকা। এর মধ্যে তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩৭ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার ৫৬২ টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ অর্থ ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৩১৯ টাকা, কোম্পানির শেয়ার সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা, বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ পাঁচ কোটি ৭০ হাজার ১১২ টাকা, যানবাহন এক কোটি ৮৩ লাখ ৮৫ হাজার ১৩১ টাকা, দুই লাখ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক সামগ্রী, দুই লাখ টাকা মূল্যের আসবাবপত্র, এক লাখ ৯০ হাজার টাকার আগ্নেয়াস্ত্র এবং ঋণ দিয়েছেন ১০ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন > প্রতি ঘরে ৪০ হাজার টাকা ইউএনওর পকেটে

স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৩০ কাঠা পৈতৃক সম্পত্তি, এক লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকায় ১৩২ দশমিক ৬৭ শতাংশ কৃষিজমি, গুলশানে প্রায় নয় লাখ ৩৪ হাজার টাকা মূল্যে ১২ দশমিক ৭ কাঠা জমি এবং গুলশান ও বাকেরগঞ্জে দুই কোটি ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ১৩৮ টাকা মূল্যের দালান। এ সময় তার কোনো ঋণ ছিল না।

কল রিসিভ করেন না হাওলাদার

এ বিষয়ে কথা বলতে ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল দেয়া হয়। জাগো নিউজের পরিচয় দিলে এক ব্যক্তি জানান, স্যার (রুহুল আমিন) নামাজে আছেন। নামাজ শেষে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে ফিরতি কল করা হবে বলে জানান ওই ব্যক্তি। কিন্তু পরে আর ফিরতি কল আসেনি। পরবর্তীতে একাধিকবার কল দেয়া হলেও রিসিভ করেননি জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার।

পিডি/এমএআর/জেআইএম