‘শ্রম’ চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশি কর্মীদের ওপর যে নির্ভরশীলতা তা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা মালয়েশিয়ার বহু পুরোনো। তবে সেটি আরও বেগবান হয় গত নির্বাচনে ডা. মাহথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসার পর। দেশটির স্থানীয় নাগরিকদের কর্ম-সংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে মাহথির প্রশাসন।
Advertisement
কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিয়ে ‘প্রথমে মালয়েশিয়ান’ নীতির আহ্বান করেছে বর্তমান সরকার। সরকারের পাশাপশি মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বিদেশি কর্মীদের পরিবর্তে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিয়ে নিয়োগ দিতে প্রস্তুত বলে গত ২ মে মালয়েশিয়ার জাতীয় দৈনিক স্ট্রিট টাইমসের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
আরও পড়ুন > মালয়েশিয়ায় শত কষ্টে বাংলাদেশিরা!
মালয়েশিয়ান নাগরিকদের নিয়োগ নীতি বাস্তবায়নের জন্য নিয়োগকর্তারা বিশ্বাস করেন, থ্রিডি (নোংরা, কঠিন এবং বিপজ্জনক) কাজকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মজুরি কাঠামো স্থির করে বেশ কয়েকটি বিষয় অবশ্যই সমাধান করা উচিত।
Advertisement
এ বিষয়ে মালয়েশিয়াার নিয়োগকর্তা ফেডারেশনের নির্বাহী সচিব দাতুক শামসুদ্দীন বারদান বলেন, ‘দেশের ২.২ মিলিয়ন বিদেশি শ্রমিকদের অপসারণের আগে থ্রিডি কাজে মালয়েশিয়ানদের নিয়োগের জন্য ইকোসিস্টেম প্রস্তুত করতে হবে।’
‘আমরা যেটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি সেক্ষেত্রে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে তা উৎপাদন বা উৎপাদনশীলতার জন্য ক্ষতিগ্রস্তের কারণ হবে না’, সম্প্রতি স্থানীয় গণমাধ্যম ‘নিউ স্ট্রেইট টাইমসকে’ দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন।
দাতুক শামসুদ্দীন বারদান বলেন- ‘আমাদের নিশ্চিত করা দরকার যে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন দক্ষ তৈরি করতে হবে যাতে বিদেশি কর্মী ছাড়াও তারা কাজ করতে পারে। নিয়োগকারীদের আরও বেশি মূলধন রাখতে হবে এবং চাকরিগুলো আরও আকর্ষণীয় এবং আধুনিকায়ন করতে হবে। যদি চাকরির ক্ষেত্রটি নতুন রূপে প্রকাশ না হয় তাহলে স্থানীয়রা শিল্পে প্রবেশ করতে আগ্রহী হবে না।’
এর আগে প্রধানমন্ত্রী তুন ডা. মহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘সরকার থ্রিডি সেক্টরে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘সরকার নারীদের কর্মক্ষেত্রে ফেরাতে নারীদের জন্য ওয়ার্ক লাইফ প্র্যাকটিস (ডব্লুএলপি) এবং ক্যারিয়ার কমব্যাক প্রোগ্রামের উদ্যোগে মনোনিবেশ করছে।’
Advertisement
এ প্রসঙ্গে শামসুদ্দিন বলেন, ‘শ্রম আইন ডাব্লুএলপির জন্য সুবিধাজনক নয়। অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের প্রতি বছর চুক্তিবদ্ধ কাজের ঘণ্টা বাস্তবায়ন করা উচিত, যার মাধ্যমে একজন কর্মচারী শুধুমাত্র এটি পূরণ করবে। এর মানে হলো একজন কর্মচারী আজ ৬ ঘণ্টা কাজ করতে পারে এবং পরের দিন ৮ ঘণ্টা কাজ করার পর গতকালের বাকি থাকে ২ ঘণ্টা কাজ করে নির্ধারিত কাজের সময় পূরণ করলো।’
‘দুর্ভাগ্যবশত, মালয়েশিয়ার প্রেক্ষাপটে, আমরা আমাদের শ্রম আইনগুলোর কারণে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহের ভিত্তিতে খুব বেশি আবদ্ধ হয়েছি’। নারী শ্রমিকদের কাজে ফিরে আনার জন্য ট্যাক্সমুক্ত করণের ওপর জোর দেন শামসুদ্দিন।
সরকারি ও বেসামরিক পরিষেবাদি (ক্যুপ্যাক) সভাপতি দাতুক আজি মুদা, মহিলাদের জন্য সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজকের নারীরা নারী শিক্ষিত এবং অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন। তারা তাদের দায়িত্ব এবং তাদের পরিবারের চাপের কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। আমদের আকর্ষণীয় প্যাকেজ প্রস্তাব করা প্রয়োজন যা তাদের চাকরিতে ফিরতে উৎসাহিত করনে আবশ্যক।’
তিনি আশা করেন, সরকার শ্রম খাতের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে, বিশেষ করে শ্রমিকদের মজুরি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিষয়ে। যদিও ন্যূনতম মজুরিটি ১,০৫০ রিঙ্গিত থেকে ১,১০০ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে তবে পাকাতান হরাপানের (ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ঘোষণায় ১,৫০০ এর তুলনা হারে কম।
মালয়েশিয়ার এসএমই অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি দাতুক মাইকেল কাং বলেন, ‘উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নূন্যতম মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি ছিল।’
ডা. তুন মাহাথিরের সঙ্গে একমত হয়ে কাং বলেছেন ‘মালয়েশিযানদের বেকার থাকা পরিবর্তে নোংরা, বিপজ্জনক এবং কঠিন (থ্রিডি) চাকরিতে যোগ দিতে হবে। মানুষের মানসিকতা এবং নির্দিষ্ট কাজের মনোভাব পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে, মালয়েশিয়ার কর্মসংস্থান নীতি পুনর্গঠন করতে হবে এবং এতে সময় লাগবে।’
তিনি আশা করেন যে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) এর অধীনে পাঠ্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ স্নাতকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্প মালিকদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে নিয়মিত আপডেট করা হবে।
এদিকে, গত ২৬ এপ্রিল দেশটির ‘দিস্টার’ অনলাইনে দেয়া সাক্ষাৎকারে মানবসম্পদ মন্ত্রী এম. কোলাসেগারান স্বীকার করেন যে, বিদেশি কর্মী পরাস্ত করা একটি কঠিন সমস্যা। নতুন উদ্ভট কিছু শিল্পের অদ্ভুত দাবির মুখে তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে মানবসম্পদ মন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদেশি কর্মী ইস্যুতে নির্বাচনের আগে দেশটির আদিবাসীদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের ব্যর্থতার আভাসই যেনো পাওয়া যায়।’
সংশ্লিষ্ট নির্ভযোগ্য একটি সূত্রে জনা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ লাখ ১৪,২০০ স্থানীয়রা চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি যা মালয়েশিয়ার মোট শ্রমশক্তির ৩.৩ শতাংশ। যেখানে ২০১৭ সালে ৫ লাখ ২,৬০০ জন বেকার ছিল। এ পরিসংখ্যান মতে’ প্রতিবছর ২.৩ শতাংশ বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে অবৈধ অভিবাসী আটকে মালয়েশিয়ার সর্বত্রই চলছে অভিযান। পরিস্থিতি অবোলোপনে বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের পথেই হাঁটছে।
পাকাতান হারাপান প্রশাসন প্রথম মেয়াদে বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস করার অঙ্গীকার করেছিল এবং ‘কখনোই শেষ না হওয়া এই ইস্যু’ কীভাবে মোকাবেলা করবেন এ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাও ছিল।
‘এটি তাদের (শিল্প মালিক) জন্য একটি বড় সমস্যা, কারণ তারা দাবি করে যে তাদের বেশি কর্মী প্রয়োজন। কাজ করার জন্য স্থানীয় কর্মী নেই।’
বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী প্রচারণায়, সরকারের প্রথম মেয়াদে বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে কমিয়ে ৪০ লাখে নিয়ে আসার অঙ্গীকার করেছিল।
বিদেশী কর্মীদের সর্বশেষ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে কোলাসেগারান জানান, গত বছরের মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন তার একটি বিদেশি কর্মীদের ‘কখনও সমস্যা শেষ না হওয়া ইস্যু’।
তিনি বলেন- ‘অনেক মালয়েশিয়ানরা হয়তো জানেন না যে বিদেশি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’
তবে তিনি যোগ করেছেন, প্রতিশ্রুতির কথা মনে রাখবে পাকাতান। বিদেশি কর্মী হ্রাস করা অসম্ভব কিছু না। শিল্প মালিকদের নির্দেশনা দেয়া আছে, যা বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরে স্থানীয় ও বিদেশি উভয় কর্মীদের উত্তম জীবন ব্যবস্থা দিতে সমর্থ হয়েছে। যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব আমরা তাই করব। অসম্পন্ন সমস্যা সামাধানের আরও সময় দরকার বলে জানিয়েছেন মানবসম্পদ মন্ত্রী এম. কোলাসেগারান।
মধ্যপ্রাচ্যের পর সবচেয়ে বড় এই শ্রমবাজার। মালয়েশিয়া সরকার এই বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠক করলেও এই বাজার নিয়ে এখনও কোনও বিষয় স্পষ্ট নয়। সর্বশেষ মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে, বিদেশি শ্রমিকদের জন্য একটি অনলাইন জব পোর্টাল খোলা হবে, যার মাধ্যমে সেদেশে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু কবে নাগাদ চালু হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই সংশ্লিষ্ট কারও। তবে আশার কথা জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম কুলাসেগেরান।
তিনি বলেছেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের অনলাইন মাধ্যমে নতুন লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে, বিশেষ করে নেপাল এবং বাংলাদেশের জন্য কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত হবে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে মালয়েশিয়ায় গেছেন ১৮ হাজার ৮৯৩ জন। এরপর ডিসেম্বর মাসে গেছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। এই বছর জানুয়ারি মাসে ২১ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ জন এবং মার্চ মাসে ২০ জন মালয়েশিয়ায় গেছেন।
সর্বশেষ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এমন স্থবিরতা দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালের পর। বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানির অন্যতম এই বাজার ২০০৯ সালে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর আবার ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর জনশক্তি রফতানিকারকদের বাদ দিয়ে সরকারিভাবে দেশটিতে কর্মী পাঠাতে জি-টু-জি চুক্তি করা হয়।
এরপর আবারও জনশক্তি রফতানিকারকদের যুক্ত করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি-টু-জি প্লাস (সরকার টু সরকার) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া বলে, এই মুহূর্তে তারা আর কর্মী নেবে না। এতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। ওই বৈঠকের পর আবার কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এমআরএম/জেআইএম