ঘূর্ণিঝড় ফণির বিপদ কেটে গেছে। জন-জীবনে স্বস্তি। কিন্তু ফণি নিয়ে রাজনীতি দেখে অস্বস্তির কাঁটা সাধারণ মানুষের মনে! প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেটাও আমাদের রাজনীতির বাইরে থাকতে পারলো না! ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব সেভাবে টের পেল না উপকূলের মানুষ। জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের পানি সেভাবে ঢুকে পড়েনি গ্রাম-গঞ্জে। কিন্তু তাতে কী! রাজনীতির নোংরা পানি ঠিকই ঢুকে পড়লো দেশজ রাজনীতির অঙ্গনে! বিশ্ব সংসারে সবাই জিততে চান। জেতার জন্য সবাই উদগ্রীব। রাজনীতির মাঠে রাজনীতিবিদরা জিততে চাইবেন এটা স্বাভাবিক। কথার লড়াইয়েও তারা জেতার জন্যই মাঠে নামেন।
Advertisement
ফণি ফণা তোলার আগে সরকারের প্রস্তুতি মোটামুটি ভাল ছিল সেটা অস্বীকার করার উপায় নাই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রস্তুত ছিল। লন্ডনে থেকে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নিয়েছেন। তিনি নিজেও খানিকটা উদগ্রীব ছিলেন। নির্দেশনা দিয়েছেন তাই সবাইকে প্রস্তুত থাকার। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে নয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের নেতাকর্মীদেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য। সত্যি কথা হচ্ছে; আবহাওয়া দপ্তরও সতর্কবার্তাটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এখন শুধু রেডিও বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের আবহাওয়া বার্তার ওপর নির্ভরশীল নন গ্রাম-গঞ্জের মানুষও।
যুগ পাল্টেছে। সময় পাল্টেছে। মানুষের হাতের মুঠোর ভেতর গোটা পৃথিবীর প্রায় সব তথ্য। তাই মানুষও আগে ভাগে প্রস্তুতি নিতে পেরেছেন। সাইক্লোন সেন্টারগুলোতে আশ্রয় নিতে পেরেছেন। যদিও আরো আধুনিক চিন্তা করার সময় এসেছে এই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু করবেন কারা? দায়িত্বটা তাদের এদেশটাকে যারা পরিচালনা করছেন এবং করবেন। এবং কাজটা রাজনীতিবিদদের।
কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় ফণি ফণা তোলার আগেই আমাদের রাজনীতিবিদরা ফণা তুললেন! এক দল আরেক দলের সমালোচনা শুরু করলেন। কে কতোটা ব্যর্থ ছিলেন দুর্যোগ মোকাবিলায়, কে কতোটা সফল তা নিয়ে শুরু হলো রাজনীতির তর্ক। আমাদের রাজনীতিবিদরা বুঝতে চাইলেন না, তাদের এই কথার লড়াই শোনার সময় ছিল না সাধারণ মানুষের।
Advertisement
‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। সম্পদ নষ্ট হয়েছে। এরপর সিডর, আইলায়ও প্রাণ এবং সম্পদ দুই গেছে। কিন্তু সেগুলো অতীত। সেই প্রসঙ্গ টেনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর মনোকষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী! কিংবা সরকার আগে-ভাগে ব্যবস্থা নিলে এবার ক্ষয়ক্ষতি কম হতো, বিরোধী শিবির থেকে এই কথাগুলোর অর্থ কী? শুধু কিছু বলার জন্য বলা ছাড়া অন্য কিছু কি?
বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিএনপি অফিসেই যার বসবাস তিনি কী অফিস থেকে বেরিয়ে কোন খোঁজ খবর নিয়েছেন মানুষর কতোটুকু কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে? না, তিনি পুরানা পল্টনে বিএনপি অফিসে বসেই সরকারের সমালোচনা শুরু করলেন। তথ্য-উপাত্ত হাতে নেই। অথচ অনেক কিছু বলে ফেললেন! তার জবাবে সরকারি দলের উত্তর এলো ’৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিএনপি কি ব্যবস্থা নিয়েছিল? উত্তরটা বিএনপি দিতে পারেনি। কারণ, এই ঝড় নিয়ে রাজনীতি করার মত প্রস্তুতিও তাদের নেই। থাকবে কীভাবে? তাদের দলের ওপর দিয়েই ঘূর্ণিঝড় বইয়ে যাচ্ছে। যাতে নিজেদের দলটাই প্রায় লণ্ডভণ্ড।
তারপরও ঝড়ের রাজনীতিতে জিততে চাইলো বিএনপি। কিন্তু ফলাফলটা কী? বিএনপির চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দিকে তীর ছুঁড়ে দেয়া হলো। যুদ্ধে নামলে তীর ছুটে আসবে সেটা জানা উচিৎ সবার। প্রতিহত করার পথটাও জানতে হবে। শুধু জানতেন না বিএনপির অফিস দুর্গ রক্ষার দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোক। তিনি ঝড়ে বিধ্বস্ত মুখায়ব নিয়ে যা কিছু বলেন, সেটা এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছেও বিরক্তিকর। একই সংগে বিব্রতকর।
রাজনীতি মানে জেতা-হারার ক্রমাগত সেই সাপ-লুডু খেলা। যে খেলার অন্তরালে থাকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ফাইল। যা আপনাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল বা কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা করে। সেই কথাটাই হয়তো বিএনপির এই নেতার খানিকটা অজানা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি এমন একটা সময় পার করছে, যখন তার নিজের সাম্রাজ্য রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে, সেই সময় অন্যের ঘরে কথার ঢিল ছুঁড়তে গেছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদে থাকা ভদ্রলোক। তাও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে।
Advertisement
আগে নিজেদের ঘরের ঝড় সামাল দেয়ার কর্মপন্থা ঠিক করেন। তারপর অন্যের সমালোচনা করার পথে হাঁটুন। পল্টনে বসে ঝড় টের পাওয়া যায় না। যেখানে ঝড়ের বাতাস বয়ে গেছে সেই এলাকার মানুষের কাছে যান।সেই সব এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিন জনগণের পাশে দাঁড়ানোর। যার যেটুকু ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত সেই লোকটার পাশে গিয়ে পারলে কিছু সাহায্য করুন। বিএনপির ত্রাণ কমিটি কী আদৌ কিছু করছে?
আসলে বিএনপির দুর্গ বলুন, সাম্রাজ্য বলুন, কিংবা দল বলুন, সেটা রক্ষার জন্য তাদের নিজেদেরই এখন রাজনৈতিক ত্রাণ দরকার। সেই ত্রাণ তারা পাবেন কীভাবে সেই খোঁজ খবরটা নেয়া এখন তাদের খুব জরুরি।
অন্যদিকে, ফণিতে হয়তো বড় ধরনের কোন ক্ষতি হলো না বাংলাদেশের। কিন্তু আগামীতে এর চেয়ে বড় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে না দেশ, সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেন না। তাই সরকার এবং সরকারী দলের নেতাকর্মীদের আত্মতুষ্টিতে ভোগাও কিছু নেই। আগামীতে কোন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে দেশ, সেটা সবাইকে নিয়ে যাতে মোকাবিলা করা যায় সেই মানসিকতা নিয়ে উদারচিত্তে কথা বলার সৌজন্য দেখানোর দায়িত্ব সরকারী দলের। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে রাজনীতি করা উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস