রাজধানীসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগুনের ভয়াবহতা আর্থিক ক্ষতিকেও ছাপিয়ে যায় মানবিক বিপর্যয়। এ বিষয়ে জাগো নিউজের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আগুনের নেপথ্যের নানা কারণ। এর মধ্যে অন্যতম ও প্রধান একটি কারণ হলো নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।
Advertisement
আরও পড়ুন > শর্ট সার্কিট থেকে ৩৯ শতাংশ আগুন
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশি-বিদেশি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। পুরান ঢাকার বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার এলাকায় নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে। নতুন মোড়কে দামি ব্র্যান্ডের লোগো হুবহু ব্যবহার করে বাজারজাত হচ্ছে এসব নকল পণ্য। শুধু রাজধানীতে নয়, বাজারজাত হচ্ছে সারাদেশেই।
সরেজমিন অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে আসলের চেয়ে ভেজাল কিংবা নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ছড়াছড়ি বেশি। সম্প্রতি রাজধানীর একাধিক স্থানে আগুন লাগার পর টাস্কফোর্স ও তদন্ত কমিটি গঠন করে একাধিক দফতর ও মন্ত্রণালয়। অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কারণ হিসেবে উঠে আসে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের বিষয়টি।
Advertisement
আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণের ডিজাইনের পাশাপাশি ইলেকট্রিক ডিজাইন এবং উন্নত ও মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারেরও পরামর্শ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
আরও পড়ুন > প্রথম জীবনের মৃত্যু হয়েছে, দ্বিতীয় জীবন পেলাম
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু ভুঁইফোড়, বেনামি প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরি করছে। কম টাকায় এসব পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা। পাশাপাশি বাড়ছে অগ্নিঝুঁকির সম্ভাবনাও। সঠিক ও নিয়মিত নজরদারির অভাবে বাজার সয়লাব হচ্ছে নকল এসব পণ্যে।
পুলিশের এলিট ফোর্স- র্যাব পরিচালিত একাধিক অভিযানে উঠে এসেছে নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল (তার) ও সরঞ্জামাদি বিক্রির তথ্য। বিআরবি, পলি ক্যাবল, প্যারাডাইজ, ইস্টার্ন ক্যাবল, বিবিএসসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করছে কিছু বেনামি কারখানা।
Advertisement
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর বংশালের সিদ্দিক ও আলুবাজারের পাঁচ কারখানা ও চার গোডাউনে অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে জব্দ করা হয় চার কোটি টাকা মূল্যের নকল বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামাদি। পরে সেগুলো সিলগালা করে দেয়া হয়। কারখানা ও গোডাউনে কর্মরত ১৮ কর্মীকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয় র্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আরও পড়ুন > মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চেয়ারেই বসেছিলেন পঙ্গু মঞ্জুর
গত ১১ এপ্রিল নবাবপুর এলাকায় নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার তৈরি, মজুদ ও বাজারজাতের অপরাধে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা এবং সাতজনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওই সময় জব্দ করা হয় দুই কোটি টাকা মূল্যের নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার।
গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর নবাবপুর এলাকায় নকল ও নিম্নমানের তার তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র্যাব। ওই সময় পরিচালিত অভিযানে ১০টি গোডাউন সিলগালা, চার কোটি টাকার মালামাল জব্দ, ১০ জনকে ৩২ লাখ টাকা জরিমানা এবং দু’জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এ বিষয়ে র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম জাগো নিউজকে বলেন, ভেজাল ও নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বিক্রির অন্যতম প্রধান স্থান হলো নবাবপুর। সেখানে তাজ মার্কেটের স্টার গোল্ড ফ্যান, খান মার্কেটের স্বর্ণা ইলেকট্রিক, তারা ক্যাবলস, রাব্বি এন্টারপ্রাইজ, এসএইচপি ক্যাবলস, জাকির মার্কেটের টিআরবি ক্যাবলস, টাওয়ার মার্কেটের সিফাত ট্রেডার্স, ক্যাপিটাল এন্টারপ্রাইজ, তানিয়া ক্যাবলসে অভিযান চালিয়ে নকল ও মানহীন তার ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
আরও পড়ুন > ১৮ তলায় উঠেও বাঁচতে পারেননি বৃষ্টি
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে অত্যন্ত নিম্নমানের ক্যাবলের (তার) ব্যবহার হয়েছে। ফলে সামান্য শর্ট সার্কিট থেকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
‘শুধু বৈদ্যুতিক ক্যাবলই নয়, অগ্নিঝুঁকি রোধকারী সার্কিট ব্রেকারও তৈরি হচ্ছে অননুমোদিত কারখানায়। যেগুলোর নিজেরই মান নেই। শর্ট সার্কিট ঠেকাবে কী করে? আমরা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনকে (বিএসটিআই) অনুরোধ করেছি, অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে অসাধু, বেনামি ও নকল বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা করতে। সে অনুযায়ী আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘দেশে এক নম্বর জিনিস পাওয়াই কঠিন। ৭০-৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে শর্ট সার্কিট থেকে। বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবল সহজলভ্য। সার্কিট ব্রেকার পর্যন্ত আপনি নকল ও মানহীন পাবেন।’
আরও পড়ুন > আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই ঢাবি শিক্ষার্থীর
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আপনি পুরান ঢাকায় যান, যান নবাবপুরে। সেখানে এক নম্বর ক্যাবলই পাবেন না। বিক্রিই শুরু হয় ১০ নম্বর দিয়ে। লো-রেট থেকে বিক্রি শুরু। এটা পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাবেন না। এখন সময় এসেছে, কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ওপর জোর দেয়ার।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক পণ্যের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ব্যবহারও। বলতে গেলে, এগুলো দেখার মতো কেউ নেই। যারাও বা আছে তাদের কাজের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
‘শর্ট সার্কিট আগুনের প্রথম কারণ। এটি ঠেকায় সার্কিট ব্রেকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানহীন ও ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের সার্কিট ব্রেকারে বাজার ভরা। এসব দেখভালের দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের। কিন্তু তারা সেটি দেখে কিনা- সন্দেহ রয়েছে।’
আরও পড়ুন > বাবার খোঁজে হাসপাতালে যমজ শিশু
এমন অভিযোগের বিষয়ে বিএসটিআই’র পরিচালক প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে নকল বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রির অভিযোগ আমাদের কাছেও আছে। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি মানহীন ও নকল পণ্য তৈরি বন্ধ করতে, এজন্য অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে। তবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।’
‘অফিসিয়াল ডিউরেশনের বাইরে আমরা কার্যক্রম চালাতে পারি না। আবার জনবলেরও প্রকট সংকট রয়েছে। তবে, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক পণ্য তৈরি করে তাহলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জেইউ/এমএআর/জেআইএম