বিশেষ প্রতিবেদন

ভারতকে বিশ্বাস করা কঠিন সাধারণ শ্রীলঙ্কানদের পক্ষে

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। লিখছেন, গবেষণা করছেন বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে। পেশাগত কারণে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায়।

Advertisement

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। ওই হামলার ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটা ধাঁধার অবতারণা করেন। বলেন, হামলা কারা এবং কেন করেছে, তা নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। আর জঙ্গি সংগঠন আইএসকে জড়িয়ে ওই হামলার যে দায় স্বীকার হচ্ছে, তা যথেষ্ট অনুমাননির্ভর।

আরও পড়ুন >> ভারত-আইএস প্রসঙ্গও আমার কাছে ধাঁধার মতো

দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রসঙ্গও। ভারতের চলতি নির্বাচন নিয়ে মতামত জানিয়ে তিনি বলেন, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ওই দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব হওয়ার আহ্বান জানান এ বিশ্লেষক। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।

Advertisement

জাগো নিউজ : দীর্ঘদিন বসবাস করে শ্রীলঙ্কার জনজীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সেখানকার রাজনীতি, সমাজে নজর রাখছেন এখনও। ওই হামলা ‘রাষ্ট্র’ শ্রীলঙ্কাকে কতটুকু আঘাত করল?

ইমতিয়াজ আহমেদ : ওই হামলা শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। তামিল টাইগারদের পতনের ১০ বছর কেটে গেছে।

দুই সপ্তাহ আগেও আমি সেখানে গিয়ে এক শান্তিময় শ্রীলঙ্কা দেখেছি। তবে তাদের অর্থনীতি খারাপ যাচ্ছিল। মূলত দেশটা এখন চীনের ওপর অধিক নির্ভরশীল। শ্রীলঙ্কায় এখন বিনিয়োগ করছে চীন-ই। অন্যরা সেখানে বিনিয়োগ করছে না বলেই চীনকে যেতে হয়েছে। যদিও শ্রীলঙ্কা এখনও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ঋণগ্রস্ত।

জাগো নিউজ : সেখানকার রাজনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে?

Advertisement

ইমতিয়াজ আহমেদ : ক্ষমতাসীনরা বেকায়দায় আছে বেশ আগে থেকেই। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে অত্যন্ত সহজেই রাজাপাকসে জয়লাভ করবেন। কোনোভাবেই তাকে আটকানো যাবে না। এক বছর ধরে আমি পর্যবেক্ষণ করে এ মন্তব্য করছি।

আরও পড়ুন >> মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ পরিবর্তন দরকার

জাগো নিউজ : রাজনীতির এ পরিবর্তন ভারত কীভাবে দেখবে?

ইমতিয়াজ আহমেদ : এটাই প্রধানতম প্রশ্ন। প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রানিল ভিক্রামাসিংহের ঐক্যের কারণেই রাজাপাকসে হেরে গিয়েছিলেন। ওই ঐক্য গঠন অনেকটা অসম্ভব ছিল, যেমন অসম্ভব বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যকার ঐক্য। কিন্তু দিল্লির হস্তক্ষেপে সম্ভব হয়েছিল।

রাজাপাকসেকে দিল্লি একেবারেই চাইছিল না। যদিও রাজাপাকসের ক্ষমতায় আসা নিয়ে ভারতের ভূমিকা ছিল। কিন্তু তিনি চীনমুখী হওয়ায় দিল্লির বিরাগভাজন হন। রাজাপাকসে সরে যাওয়ার পর দিল্লি খুবই উৎফুল্ল ছিল, উৎফুল্ল ছিল সিরিসেনা-রানিলের অনুসারীরাও।

আমি শ্রীলঙ্কায় থেকে দেখেছি, রাজাপাকসে ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর প্রায় এক বছর চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। চীনের প্রকৌশলীরা তখন বসে বসে তাস খেলত। একবারেই অলস সময় তখন।

ওই পরিস্থিতি দেখে আমি ইন্ডিয়ানদের বলেছিলাম, তোমরা শ্রীলঙ্কাকে আরও চীনের ওপর নির্ভরশীল করে দিচ্ছ। তারা বলল, কীভাবে? বললাম, চীন যে পরিমাণ বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রাখে তার সঙ্গে আর কোনো দেশই কুলিয়ে উঠতে পারবে না। বিশ্বের কেউ পারবে না। চীনবিরোধী মনোভাব থাকতেই পারে। বাস্তবতা তো অস্বীকারের উপায় নেই।

আরও পড়ুন >> যেভাবে লঙ্কান হামলার নীলনকশা উন্মোচন করে ভারতীয় গোয়েন্দারা

আমরা দেখেছি, রানিল ভিক্রামাসিংহে ক্ষমতা নেয়ার পর কয়েকবার দিল্লি গেলেন। ফিরেছেন শূন্য হাতে। দিল্লির পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় গভীর সমুদ্রবন্দর করে দেয়ার। চীন হয়ত এখন করছে না। কিন্তু যে কোনো সময় করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

শ্রীলঙ্কায় গেলেই দেখা যায় চীনের বিনিয়োগ কীভাবে প্রভাবিত করেছে। ক্ষমতা নেয়ার এক বছর পর যখন রানিল বেইজিং গেল তখন চড়া সুদে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে এল। কারণ এক বছর চীনকে বসিয়ে রেখেছিল শ্রীলঙ্কা। তারই খেসারত দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশকেও একই নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থ দেয়া বন্ধ করার পর চীনের কাছে যেতে হয়েছে। টাকা লাগবে। বসে থাকলে তো চলবে না। চীন থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভারত চিন্তিত হয়ে পড়ল। ভারত যখন চিন্তিত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ঘোষণা দিলেন, আরও দুটি সাবমেরিন কেনা হবে। ভারত তখন চুপ। ভারত চীনের সঙ্গে ব্যবসা করলে দোষ নেই। অন্যরা করলেই সমস্যা!

গত এক বছর ভারতের যত শিক্ষার্থী ইংল্যান্ড গেছে, তার চেয়ে বেশি গেছে চীনে। ভারতে চীনের বিনিয়োগ আছে, ব্যবসা আছে। বিরাগভাজন অন্যের বেলায়। ভারতের গবেষকরাই বলছেন, চীন শ্রীলঙ্কায় পোর্ট বানিয়ে দিলেও এর বেশির ভাগ ব্যবহার করবে ভারত-ই।

জাগো নিউজ : তাহলে ভয় কীসের?

ইমতিয়াজ আহমেদ : সামরিক ভয় থেকেই এমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। ১৯৬২ সালে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেখান থেকেই চীনকে ভয় করে ভারত। কিন্তু বিশ্ব তো এখন অনেক এগিয়েছে। বিশ্ব আর ষাটের দশকে নেই। চীননীতিতে ভারত শ্রীলঙ্কায় যে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেবে।

আরও পড়ুন >> ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ সম্পর্কের হেরফের হবে না

জাগো নিউজ : শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ ভারত-চীনের এ সম্পর্ক কীভাবে দেখে?

ইমতিয়াজ আহমেদ : শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের পক্ষে ভারতকে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তামিল টাইগারসকে ভারত-ই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। অস্ত্রও দিয়েছিল। এটা সিংহলিরাও ভুলবে না, তামিলরাও ভুলবে না। কারণ ক্ষতি উভয়েরই হয়েছে। আবার তামিলরা যখন ভারতের কথা শুনল না, তখন ভারতের হস্তক্ষেপে তাদের একেবারে খতমের ব্যবস্থা নেয়া হলো। ওই রক্তের ইতিহাস তো তারা ভোলেনি।

ভারত একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না। বিশেষ কায়দায় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করতে অভ্যস্ত। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব আগে জনগণকেই আমলে নেয়।

জাগো নিউজ : এক যুগ আগের রক্তাক্ত ইতিহাস ভোলেনি শ্রীলঙ্কাবাসী। সম্প্রতি এ হামলা সেখানে অস্থিরতা বাড়াবে কিনা?

ইমতিয়াজ আহমেদ : শ্রীলঙ্কার মানুষ যুদ্ধ করতে করতে খুবই ক্লান্ত। ৩০ বছর যুদ্ধ চলেছে। কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ কারণেই তারা চীনের কাছে গেছে। চীন তাদের অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে। অতীতে শ্রীলঙ্কাকে বহু দেশ শাসন করেছে। মানুষের মধ্যে সে শাসনের প্রভাবও আছে। ঔপনিবেশিক শাসকরা শাসন করলেও তাদের বিদায় ছিল শান্তিপূর্ণ। এ কারণে বাইরের দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো। ঠিক আমাদের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা নয়।

আরও পড়ুন >> ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ‘সাময়িক’

এমন শান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে তারা নিজেরা নিজেরা ৩০ বছর যুদ্ধ করেছে। শ্রীলঙ্কার মানুষ আর অশান্তি চায় না। এ কারণেই আমি মনে করি, হামলার পরবর্তী পরিস্থিতি তারা সামাল দিতে পারবে। তামিলরা এখন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা সিংহলি সিংহলির মধ্যে। এ বিভাজনের সুযোগটা-ই অন্যরা নিচ্ছে।

জাগো নিউজ : সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে কী করতে পারে তারা?

ইমতিয়াজ আহমেদ : আমি মনে করি আরও স্মার্ট (বিচক্ষণ) হওয়ার সময় এসেছে শ্রীলঙ্কাবাসীর। অন্তত নিজেদের শত্রু চেনার কোনো বিকল্প নেই তাদের সামনে।

জাগো নিউজ : এ প্রশ্নে রাজাপাকসে গুরুত্ব পেতেই পারেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ : প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা অক্টোবরে যখন বলল, তাকে ভারতের গোয়েন্দারা মারতে চাইছে এবং একই ষড়যন্ত্রে রাজাপাকসের ভাইকেও মারতে পারে, তখন অনেক প্রশ্ন সামনে এসেছিল। কেউ কেউ বলছিল, সিরিসেনা এসব আলোচনা করে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। কেউ বলছিল, রাজাপাকসেকে ঠেকানোর জন্যই এমন ষড়যন্ত্রের গন্ধ।

কারণ সিরিসেনার জনপ্রিয়তা এখন একেবারেই তলানিতে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসবে। তার প্রতি জনআস্থা যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি।

এএসএস/এমএআর/এমকেএইচ