>> আস্থা সংকট, তারল্য সংকট- সবকিছুর পেছনেই ব্যাংক>> ব্যাংকের ওপর সূচকের ওঠা-নামার বড় অংশই নির্ভর করে>> লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়ায় সমস্যা আরও বাড়বে
Advertisement
চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে দেশের শেয়ারবাজারে। একের পর এক প্রতিষ্ঠানের দরপতনের ফলে প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
দরপতনের ভয়াবহতা অনুধাবন করে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। এমনকি সরকারি বন্ধের দিনেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। এরপরও থামছে না দরপতন। এ পরিস্থিতিতে দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতীকী গণঅনশনের ডাক দিয়েছেন বিনিয়োগকারী।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে রয়েছে। সেই সঙ্গে তারল্য সংকট রয়েছে। তবে তারল্যের থেকে বাজারে এই মুহূর্তের বড় সমস্যা আস্থা। বিনিয়োগকারীদের এই আস্থা সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে ব্যাংক খাতের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন > ডিএসইর মূল্য আয় অনুপাত আরও কমেছে
তারা বলছেন, শেয়ারবাজারকে ব্যবহার করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকের অর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। বরং কিছু কিছু ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ২০১৮ সালের সমাপ্ত বছরের জন্য কোম্পানিগুলোর ঘোষিত লভ্যাংশ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
তাদের মতে, কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাত চরম দুরবস্থার মধ্যে থাকলেও এখনও দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বড় অবদান রয়েছে। ব্যাংকের ওপর এখনও সূচকের ওঠা-নামার বড় অংশই নির্ভার করে। ব্যাংক কোম্পানিগুলো ভালো পারফরমেন্স করলে সার্বিক শেয়ারবাজারের ওপর তার ইতিবচক প্রভাব পড়ে। ঠিক তেমনি ব্যাংকের খারাপ অবস্থা শেয়ারবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ১৬টি ব্যাংক ২০১৮ সালের সমাপ্ত হিসাব বছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৮টি ব্যাংকই শেয়ারহোল্ডারদের আগের বছরের তুলনায় কম লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ৮টির মধ্যে ৪টির লভ্যাংশ আগের বছরের সমান রয়েছে। আর যে ৪টি ব্যাংকের লভ্যাংশের পরিমাণ বেড়েছে তার মধ্যে ২টি লভ্যাংশ হিসেবে শুধু বোনাস শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন > শেয়ারবাজারের পতনের পেছনে কেউ আছে
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ হিসেবে যে হারে বোনাস শেয়ার দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছে, তা খুব একটা ভালো বার্তা বহন করছে না। দুরবস্থার কারণেই হয়তো ব্যাংকগুলো এভাবে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে। এতে ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারের মূল্যে। আর বছরের পর বছর লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা বাস্তবে খুব একটা লাভবান হচ্ছে না। যার নেতিবাচক প্রভাব সার্বিক বাজারে পড়ছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাভুক্ত যে ১৬টি ব্যাংক ২০১৮ সালের লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে এর মধ্যে ৬টি লভ্যাংশ হিসেবে শুধুই শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ১০টির মধ্যে ৬টি নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি বোনাস শেয়ারও দেবে। আর যে ৪টি শুধু নগদ লভ্যাংশ দিতে চেয়েছে তার মধ্যে ৩টির ঘোষিত লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে এবং একটির অপরিবর্তিত রয়েছে।
আগের বছরের তুলনায় লভ্যাংশ কমে যাওয়া ৮ ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ শুধু ২০১৭ সালের তুলনায় নয়, ২০১৬ সালের তুলনায়ও কমেছে।
১৬ ব্যাংকের চার বছরের লভ্যাংশের চিত্র-
ব্যাংকের নাম
লভ্যাংশ(%)
২০১৮
২০১৭
২০১৬
২০১৫
নগদ
শেয়ার
নগদ
শেয়ার
নগদ
শেয়ার
নগদ
শেয়ার
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক
১৫
২
১৫
৫
২০
-
১০
৫
ইসলামী ব্যাংক
১০
-
১০
-
১০
-
২০
-
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক
-
১০
-
১০
১০
৫
১৩
-
যমুনা ব্যাংক
২০
-
-
২২
২০.৫
-
১৯.৫
-
সিটি ব্যাংক
৬
৫
১৯
৫
২৪
-
২২
-
ঢাকা ব্যাংক
৫
৫
-
১২.৫
১০
৫
৬
১০
ইবিএল
২০
১০
২০
-
২০
৫
২০
১৫
পূবালী ব্যাংক
১০
৩
৫
৫
৫
৮
১২
-
প্রাইম ব্যাংক
১২.৫
-
৭
১০
১৬
-
১৫
-
প্রিমিয়ার ব্যাংক
-
১৫.৫
-
১৫
১০
২
-
১০
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
-
১০
-
১০
৫
৫
১০
-
ব্যাংক এশিয়া
৫
৫
-
১২.৫
-
১২
১৫
৫
ব্র্যাক ব্যাংক
-
১৫
-
২৫
১০
২০
২৫
-
ডাচ-বাংলা ব্যাংক
-
১৫০
৩০
-
৩০
-
৪০
-
এক্সিম ব্যাংক
১০
-
১২.৫০
-
১৫
-
১২
-
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক
-
১০
-
১০
৫
৫
-
১৫
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারের এই দুরবস্থার জন্য সব থেকে বেশি দায়ী ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার জন্য পুঁজিবাজারের ৩০ লাখ বিনিয়োগকারীকে ভুগতে হচ্ছে। আস্থা সংকট, তারল্য সংকট যে যাই বলুক এর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে ব্যাংক। ব্যাংকগুলো যদি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ভালো লভ্যাংশ দিত তাহলে শেয়ারবাজারের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। বাজারে কোনো তারল্য সংকট থাকতো না।
তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক এত বড় ব্যাংক, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি শেয়রহোল্ডারদের মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ কোম্পানিটি গত পাঁচ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি মুনাফা করেছে। ২০১৮ সালের ব্যবসায় ব্যাংকটি যে মুনাফা করেছে লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের তার পাঁচ ভাগের মাত্র একভাগ দিচ্ছে। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কীভাবে থাকবে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারের যে চিত্র তা তারল্য সংকট ও আস্থা সংকটের ইঙ্গিত করে। এই তারল্য সংকটের একটি কারণ ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়। এছাড়া এখন পর্যন্ত যে কয়কটি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার বেশ কয়েকটির লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় কম। যা বাজারের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ ব্যাংকের অবস্থা খারপ হলেও শেয়ারবাজারের ওপর এখনও ব্যাংকের বড় প্রভাব রয়েছে।
আরও পড়ুন > সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছে ডিএসই
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। এসব শেয়ারের বিপরীতে নগদ লভ্যাংশ দিতে হিউজ অর্থের দরকার। ব্যাংকগুলোর কাছে হয়তো সেই পরিমাণ তারল্য নেই। যে কারণে বোনাস শেয়ারের দিকে ঝুঁকছে।
তিনি বলেন, গত দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলো যে হারে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দিচ্ছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে এ খাত সমস্যার মধ্যে আছে। এভাবে লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার দেয়ার ফলে সমস্যা আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের এই অবস্থা শেয়ারবাজারের ওপর অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেশকিছু দিন ধরে বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যখন ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করছে না, তা সার্বিক বাজারের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কারণ ভালো লভ্যাংশ না পেলে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে এক ধরনের বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। আর ব্যাংকের শেয়ার যেহেতু বেশি, সেহেতু বিক্রির চাপ বাড়লে এক ধরনের প্যানিক সৃষ্টি হতে পারে।
এমএএস/এমবিআর/জেআইএম