মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় প্রকল্প ভিত্তিক ঘর নির্মাণে নির্ধারিত প্ল্যান ও ডিজাইন মোতাবেক কাজ না করে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ উঠেছে। ঘর পেলেও তা কতদিন টিকবে সেটা নিয়ে সংশয়ে আছেন উপকারভোগীরা।
Advertisement
উপকারভোগীদের অভিযোগ, গরিব মানুষদের আশ্রয়ের জন্য নির্মিত এসব ঘর নির্ধারিত আয়তনের চেয়ে ছোট করে তৈরি করা হয়েছে। পিলারে গ্রেড রডের পরিবর্তে নন-গ্রেড রড ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া রড বাঁধায়ে রিং (চুড়ি) হিসেবে রডের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ৮ নম্বর জিআই তার এবং তৃতীয় শ্রেণির ইটের খোয়া। এমনকি এক ফুট দূরত্বে রিং দেয়ার কথা থাকলেও ১৬ ইঞ্চি পর পর লাগানো হয়েছে রিং। ঘরের কাজে ব্যবহৃত কাঠের মান ও সাইজেও রয়েছে ত্রুটি।
কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের কানাইটিকর গ্রামের রব উল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন। কিন্তু ঘর পেয়ে খুশি নন তিনি। প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই ঘর দিয়ে কী করব? সামান্য বাতাসেই ঘর উড়ে যাবে। খুব নিম্নমানের কাজ হয়েছে। কতদিন বাস করতে পারব জানি না।
গনিপুর গ্রামের আব্দুল আহাদ জানান, পিলার পোঁতার কথা ৩ ফুট কিন্তু এক দেড় ফুট পোঁতা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করার কারণে এক মাসের মাথায় ঘরের মেঝে ফেটে গেছে।
Advertisement
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নকসা ও প্রাক্কলন থেকে জানা গেছে, প্রতিটি ঘরের মেঝে ১৫০ মিলিমিটার বালি দেয়ার পর ডাবল লেয়ার পলিথিনের ওপর ঢালাই দিতে হবে। ১৭৫ বর্গফুট আয়তনের একটি ঘরে ৪ বর্গফুটের ১২টি পিলার থাকবে। এগুলোর উচ্চতা হবে ১২ ফুট। বারান্দা এবং ল্যাট্রিনে ১০ ফুট উচ্চতার ৯টি খুঁটি দেয়ার কথা।
কিন্তু সরেজমিনে এর মিল পাওয়া যায়নি। ১২টি পিলার ১০ ফুট করে এবং ৯টি পিলার ৮ ফুট করে। ৬ মিলিমিটার রডের স্থলে ব্যবহৃত হচ্ছে ৪ মিলিমিটারের ৩টি রড। আর রিং হিসেবে ৪ মিলি. রডের পরিবর্তে মোটা তার ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ৪টি জানালায় লোহার গ্রিল দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। ঘর ও বারান্দার মেঝে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চি ধরা থাকলেও ১-২ ইঞ্চি দিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
উপকারভোগীরা অভিযোগ করেন, বরাদ্দকৃত অর্থের সম্পূর্ণ টাকা ব্যয় করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে অসহায় মানুষের শতভাগ স্বপ্ন পূরণ হতো।
জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলায় মোট ২৯৪টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সরকার প্রতিটি পাকাঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ঘর নির্মাণ শেষে বাড়তি টাকা সুবিধাভোগীদের ফেরত দেয়ার নিয়ম থাকলেও এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি এ টাকা।
Advertisement
অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসন নিজেদের পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ দেয়। তাদের নিয়োগকৃত রাজমিস্ত্রি ও কাঠমিস্ত্রিরা ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। কাজে আপত্তি জানালে উপকারভোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন।
নীতিমালা অনুযায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ পিআইসির মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কাজ করার কথা থাকলেও পিআইসির সভাপতি (ইউএনও) নিজের পছন্দের লোকজনকে দিয়ে কাজ করান। পিআইসির অন্য সদস্যরা হলেন- উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন র্কমর্কতা (পিআইও), সদস্য সচিব (উপজেলা প্রকৌশলী), উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।
বরমচাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আহবাব চৌধুরী জানান, তালিকা করার সময় কিংবা কাজ করার কিছুই আমরা জানি না। যখন জানলাম তখন দেখি এক ওয়ার্ডে ৩টা আরেক ওয়ার্ডে ৭টা ঘর তৈরি হচ্ছে।
ঠিকাদার রাজিব মন্ডল জানান, সবকিছু জানেন ইউএনও। তিনি সব বলতে পারবেন। আমি শুধু টিন কিনে দিয়েছি।
এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল লাইছ জানান, অনিয়ম বিষয়টি ঠিক না। সরকারের প্রাক্কালন বিষয়টি না জানার কারণে অনেকে অভিযোগ করছে। ২০১৬ সালে উপজেলা থেকে তালিকা দেয়া হয়েছে। সেটি করেছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাদের বলা হয়েছিল উচু ভিটা নেই এমন ব্যক্তির নাম না দেয়ার জন্য কিন্তু তারা হাওরাঞ্চলের অনেকের নাম দিয়েছেন। কিন্তু ভিটে ভরাটে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। দু’এক স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে আমরা সেগুলো মেরামত করে দিচ্ছি।
তবে উপজেলায় প্রায় ৩শ বাড়ি নির্মাণের অনিয়মের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ঘটনা তদন্তে মাঠে নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি টিম। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. এরশাদ মিয়ার নেতৃত্বে ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল দিনভর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নির্মিত ঘর পরিদর্শন করেন।
দুদক হবিগঞ্জ অঞ্চলের ডেপুটি ডাইরেক্টর অজয় সাহা বলেন, আমরা সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে তদন্ত করে যাচ্ছি। তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেব। তবে তদন্তধীন বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।
রিপন দে/এফএ/জেআইএম