ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এবার দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ; ১. রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে উদ্যোগ এবং ২. তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে প্রথমবারের মতো হিজড়াদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু এই ইস্যুতে কিছু প্রশ্নও আছে।
Advertisement
ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুধু ভোটার হওয়ার জন্যই জরুরি নয়; বরং একজন নাগরিক ভোটার হলে তাকে যে জাতীয় পরিচয়পত্রটি দেয়া হয়, সেটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন তোলাসহ রাষ্ট্রের সব কাজে এখন বাধ্যতামূলক। ফলে ভোটের বাইরেও এর একটি গুরুত্ব আছে।
আবার এর একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে। সেটি হলো, যিনি ভোটার তালিকা অন্তর্ভুক্ত হবেন, অর্থাৎ ভোটার হবেন, তিনি আদৌ ভোট দিতে পারবেন কি না বা দেবেন কি না? কারণ জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার—সব নির্বাচনেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। অর্থাৎ একাধিক প্রার্থী থাকছে না। কেন থাকছে না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
একাধিক প্রার্থী না থাকলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হবেন এটিই আইনসিদ্ধ। কিন্তু আইনসিদ্ধ হলেও নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ভোট তার পবিত্র আমানত ও সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং যখন কেউ বিনা ভোটে জয়ী হচ্ছেন, সেটি আইনত বৈধ হলেও নাগরিক তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
Advertisement
ভোট মানে একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে যোগ্যতমকে বাছাই। সুতরাং ভোট ছাড়াই যদি একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে যান, তাহলে তাকে নির্বাচিত প্রতিনিধি বলা যাবে কি না—সে প্রশ্নও আছে। কেননা বিনা ভোটে জয়ী মানে একধরনের সিলেকশন। সিলেকশন কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এরকম বাস্তবতায় এবার যারা নতুন ভোটার হবেন, তাদের কত শতাংশ ভোট দেবেন বা দিতে পারবেন, সেটি একটি বড় সংশয়ের বিষয়। কেন সব নির্বাচনে এরকম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে?
প্রধানত রাজনীতি ও ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে বা না রাখা হলে এবং নিজেদের দলের ভেতরেও একাধিক প্রার্থিতাকে নিরুৎসাহিত করার ফলেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যার সবশেষ উদাহরণ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন ঘোষণা হওয়ার পর আগামী ৫ মে এখানে প্রথমবারের মতো নির্বাচন হবে।
কিন্তু একাধিক প্রার্থী না থাকায় এরইমধ্যে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটু। এর আগে উপজেলা নির্বাচনের চার ধাপে ১০৮ জন চেয়ারম্যান বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা যে গণতন্ত্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যারা বিনাভোটে জয়ী হচ্ছেন, ধরে নেয়া যাক যে নির্বাচন হলেও তারাই জয়ী হতেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহে যিনি মেয়র হলেন, তিনি নানা কারণেই জনপ্রিয় এবং নাগরিকরা ভোট দিতে পারলে হয়তো তাকেই নির্বাচিত করতেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো তিনি একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র হলেন ভোট ছাড়াই—এটি নিশ্চয়ই তার নিজের জন্যও খুব স্বস্তির বা সম্মানের নয়।
Advertisement
২.এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রায় ৮০ লাখ নাগরিকের তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে নির্বাচন কমিশন। ১৩ মে পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। ২০০৪ সালের পয়লা জানুয়ারি বা তার আগে যাদের জন্ম তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এরমধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তাদের নাম ২০২০ সালে প্রকাশিত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আর তাদের বয়স এখনো ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি, তাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
যাদের জন্ম ১ জানুয়ারি ২০০১ বা তার আগে অথচ বিগত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে বাদ পড়েছেন তাদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করা হচ্ছে। কোনো কারণে তথ্য সংগ্রহের সময় কেউ যদি বাদ পড়েন তবে তিনি নিবন্ধন কেন্দ্রে গিয়েও তার তথ্য দিয়ে নিবন্ধিত হতে পারবেন। তথ্য সংগ্রহকারীগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন ও বাদ পড়া ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করবেন। এ সময় ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য মৃত ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
কিন্তু সারা বছরই নাগরিকদের তরফে তাদের ভোটার আইডি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করতে গিয়ে হয়রানির বিস্তর অভিযোগ সংবাদ শিরোনাম হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র একজন নাগরিকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সম্মানের বস্তু। কিন্তু এখানে নামের বানান, বাবা মায়ের নাম, বয়স ইত্যাদি ভুল থাকে। একটি বর্ণের ভুলের কারণেও এই কার্ডের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আর এই সুযোগে কার্ড সংশোধনের নামে নাগরিকদের হয়রানি করে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
প্রতিটি জেলায় যে সার্ভার স্টেশন আছে, সেখানে গিয়ে নির্ধারিত ফরমে আবেদন এবং সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়েও মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ঘুরেও কার্ড সংশোধন করতে পারেননি, এরকম লোকের সংখ্যা অগণিত। অনেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে দ্রুত সংশোধন করতে পারেন—সেই খবরও নতুন কিছু নয়।
সুতরাং নির্বাচন কমিশন যখন ভোটার তালিকা হালনাগাদের উদ্যোগ নেয়, তখন নাগরিকদের তরফে এই প্রশ্নও ওঠে যে, পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনের নামে হয়রানির অবসান হচ্ছে না কেন? কেন এই ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা হচ্ছে না? কেন সার্ভার স্টেশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
তারও চেয়ে জরুরি প্রশ্ন, এরকম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তৈরিতে ভুল থাকবে কেন? এরকম একটি রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্রে নামের বানান ও তথ্যের ভুল কেন থাকবে? কেন এটি ছাপার আগেই কয়েক ধাপে যাচাই-বাছাই করা হবে না? নাকি এই ভুলগুলো রেখেই দেয়া হয় কিছু অসাধু লোকের পয়সা খাওয়া এবং নাগরিকদের হয়রানি করার জন্য?
৩.এবারের হালনাগাদে হিজড়া জনগোষ্ঠীর লোকেরা ‘হিজড়া’ হিসেবে ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারবেন। নিঃসন্দহে এটি একটি বড় উদ্যোগ। হিজড়াদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিতে এটি সরকারের একটি বড় পদক্ষেপ।
হিজড়াদের সমাজের মূল স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের ‘হিজড়া’ নামেই সম্বোধন করা হয়। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। যদিও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে এই সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ হাজার। কারো কারো মতে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হিজড়াদের সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে আমন্ত্রণ জানায়। এরপরের বছর ২০১৫ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক হিজড়া উদ্যোক্তাদের এসএমই খাত থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, নকশিকাঁথা ও তাঁত, নার্সারি, নির্মাণ শিল্প ও গৃহায়ন, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, বিস্কুট ফ্যাক্টরি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন, সেলুন ও বিউটি পার্লার প্রভৃতির জন্য ঋণ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে নাগরিকরা অতিষ্ঠ। অভিযোগ আছে, এদের মধ্যে অনেকেই আসলে হিজড়া নন। তারা হিজড়া সেজে এই অপকর্ম করেন। ফলে এবার নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে ফাঁকতালে এই নকল হিজড়া ঢুকে পড়বে কি না বা আসল হিজড়ারাই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটি নিশ্চিত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। আবার সব হিজড়া ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন কি না সে শঙ্কাও রয়েছে।
৪.এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদের আরেকটি ভালো উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকানোর উদ্যোগ। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে। বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে সাম্প্রতিক সংকটে পালিয়ে আসাদের নিয়ে এখন কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের কাঁধে।
এবারই প্রথম তাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করা হয়। ফলে যাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হয়েছে তারা ভোটার হতে গেলে ধরা পড়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবাইকে এই বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়নি। তারা সহজেই ভোটার তালিকায় ঢুকে যাবেন এবং অতীতেও তাদের অনেকে ভোটার হয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহায়তায় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্টও করেছেন, এরকম খবরও নতুন কিছু নয়। ফলে এবারও ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কতটা দক্ষতার সাক্ষর রাখেন, তারউপর নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের আসলেই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ঠেকানো যাবে কি না যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি