শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর আশেপাশের কয়েকটি শহরে একযোগে একাধিক চার্চ ও হোটেলে বোমা হামলায় নিহত তিনশ’র বেশি মানুষ এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে কেবলই একটি সংখ্যা। এই সংখ্যাটি তিনশ’র বেশি হওয়ায় গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়ে থাকবে হয়তো আরও কিছুদিন, এরপর আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত আমরা হয়তো ভুলে যাবো যে, শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর মানচিত্রের বাইরের কোনো দেশ নয়, এরপর পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশে এরকম ‘মানুষের দ্বারা, মানুষের ওপর’ ভয়ঙ্কর ও ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি কিনা এই কিছুদিন আগেই ঘটেছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে।
Advertisement
মজার ব্যাপার হলো, নিউজিল্যান্ডে যখন একজন খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী সেখানে মসজিদে হামলা করে মানুষ হত্যা করে তখন আমাদের দেশের ভেতর থেকেই কড়া ও কঠোর সমালোচনাকারীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো। এমনকি একথাও জোর দিয়ে বলা হচ্ছিলো যে, হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ বলেই তাকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ কিংবা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত বলে অভিহিত করবে গণমাধ্যম। কিন্তু হামলাকারী যদি মুসলিম হতো তাহলে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে কেন সরাসরি আখ্যা দেওয়া হয় সে প্রশ্ন তোলাটা তখন খুবই মামুলি হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু একথা কেউই স্বীকার করতে আমরা নারাজ যে, গত এক দশকে বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যতোগুলো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবক’টিই ঘটিয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মসম্প্রদায় তথা মুসলমান সন্ত্রাসীরা। ফলে এখন কি পশ্চিম, কি পূবে, কি উত্তর কি দক্ষিণে, সর্বত্রই ইসলাম ধর্মকেই সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়া একটি ধর্ম হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে এবং সর্বত্রই ইসলামে বিশ্বাসীদের একটু সন্দেহের চোখেই দেখা হচ্ছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া ধর্মসন্ত্রাসকে উস্কে দেওয়ার রাজনীতি, যা মূলতঃ করে চলছে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি, যাদের হাতে অস্ত্র-অর্থ-গণমাধ্যম এবং শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনীও রয়েছে। নিজেদের রাজনীতি, ব্যবসা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তারা দেশে দেশে বোমা হামলা থেকে শুরু করে সরকার পরিবর্তন সবই করে থাকে এবং মানুষকে দিয়েই মানুষ হত্যার যে কৌশল তারা আয়ত্ব করেছে তাকেই আবার বর্বরতম সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গালভরা নাম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
Advertisement
মোটকথা, এই বিশ্ব এখন আর মানুষের জন্য কোনো ভাবেই নিরাপদ নয়, কারণ এখানে মানুষেরই হাতে আক্রান্ত মানুষ, মানবতা বলতে এখন আর কোনো সুনির্দিষ্ট গুণাবলীকে বোঝায় না, বরং প্রতিটি রাষ্ট্র ও শাসক তাদের নিজস্ব মানদণ্ডে মানবতা মাপার চেষ্টা করেন, যখন যেমনটি তাদের প্রয়োজন ঠিক তেমন ভাবেই মানবতাকে তাদের চশমায় দেখে থাকেন। এটাই আসলে সাধারণ্যেও ছড়িয়েছে নাহলে ক্রাইস্ট চার্চের হামলাকারীর জন্য নিন্দা জানানোর ভাষা খুঁজে পেলে শ্রীলঙ্কার হামলাকারীদের ক্ষেত্রে নিন্দা প্রকাশের ভাষায় এতো দীনতা কেন থাকবে?
শ্রীলঙ্কা দেশটি এমনিতেই নিজেদের আকারগত ক্ষুদ্রতা নিয়ে মহাসাগরের মাঝখানে একটি বিন্দু হয়ে অবস্থান করলেও তাকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কিন্তু বিগত বহু বছর যাবতই ভয়ঙ্কর আর রক্তাশ্রয়ী। একটি দীর্ঘ সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শ্রীলঙ্কাকে বিপর্যস্ত করলেও এদেশের মানুষ সম্পর্কে পৃথিবীর কোথাও থেকে নেতিবাচক কোনো আলোচনা শোনা যাবে না। অথচ যারাই এদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন তারাই একথা স্বীকার করেন যে, সাধারণ লঙ্কান নাগরিক শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী এবং পশ্চিমা উদারনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী জনগণ।
সেই শ্রীলঙ্কাতেই যখন বহু প্রচেষ্টা আর রক্তক্ষয় শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক ভাবেই নিকটতম দুই আগ্রাসী মহাশক্তির রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের টানাটানির ভেতর থেকেও দেশটি মাথা সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখনই একই দিনে একাধিক জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনশ’র কাছাকাছি মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কায় নয়, বরং এই উপমহাদেশেই নতুন করে ঘৃণা, সন্ত্রাস ও ভয়ঙ্করের যাত্রা শুরু হলো, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
ভারতের মতো বিশাল গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মুহূর্তে। সেখানে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র হাতে দেশোন্নয়নের পক্ষে কোনো শাণ দেওয়া যুক্তি নেই, কিন্তু তাদের হাতে আছে যুদ্ধবাজি আর উপমহাদেশের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দেওয়ার মতো ক্ষুরধার রামদা, এবং এটি তারা ব্যবহারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না।
Advertisement
বলাই বাহুল্য যে, শ্রীলঙ্কায় খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীদের ইস্টার আয়োজন চলাকালে একাধিক চার্চ ও হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পরে ভারতে মোদি-চিহ্নিত ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’-কে ঘৃণার চর্চা আরও হাওয়া পাবে এবং হয়তো এরপর মোদির পক্ষে ভোটও বেশি পড়তে পারে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় হামলাকারীরা হয় জেনেশুনে নাহয় অজ্ঞাতে একটি সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধবাজ শাসকের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদ ঠিক এভাবেই ব্যবহৃত হলেও, এর অন্য দিকটি অর্থাৎ যারা এই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে অংশগ্রহণ করছে তাদের মনস্ত্বও আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে, কারণ ইসলামের নামে, ইসলামকে ব্যবহার করে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেশে দেশে এই যে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী তৈরি করা হচ্ছে, এরও একটা বিহিত হওয়া এখন সময়ের দাবি।
প্রশ্ন হলো সময়ের এই দাবি পূরণে বাংলাদেশের মতো দেশের নাগরিক যারা আসলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন জীবনের তাগিদে, যাদেরকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে কাজ করেই জীবিক নির্বাহ করতে হবে তারা কতোটা আগ্রহী ও এগিয়ে আসবেন? শুরুতেই বলেছি যে, ক্রাইস্ট চার্চের আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর ভাষায় আমাদের কোনো কমতি ছিল না, কিন্তু শ্রীলঙ্কায় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে আমরা বলছি ‘সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম-বর্ণ নেই’ অর্থাৎ আমরা আক্রমণকারীদের ধর্মবিশ্বাসকে আলোচনায় আনতে নারাজ।
বাংলাদেশেও আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে বোমা বিস্ফোরণের শিকার হওয়ার। এমনকি আত্মঘাতী আক্রমণ হোলি আর্টিজান সারা বিশ্বে বাংলাদেশের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করেছে। যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবেই বাংলাদেশকে ‘মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে তকমা দিয়ে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালানো হয়েছিল এবং দেশের ভেতর পাঁচশর’ও বেশি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাকে অস্বীকার করে দেশীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসকে ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে হাস্যকর কথা বলা হতো। কিন্তু আমরাতো একথা সকলেই জানি যে, বাংলাদেশেও ধর্মের নামে ও ধর্মকে দিয়ে সাধারণ জনগণের ওপর আক্রমণ/আঘাত কম হয়নি, কিন্তু এখনও আমরা স্বীকার করতে নারাজ যে, এর সঙ্গে ধর্মের আসলেই যোগসূত্র রয়েছে।
আজকে শ্রীলঙ্কায় যে ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে সেরকম বা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতেই পারে এবং শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব মাত্র একটি মহাসাগরের ক্ষুদ্র একটি উপসাগর। আমরা যতো দ্রুত এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারতো ততো দ্রুতই আমাদের এই ব্যাপক জনবহুল রাষ্ট্রটির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারবো।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি থাকবে, আন্তর্জাতিক শক্তিবলয় বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলাধুলাও চালিয়ে যাবে। তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সামান্যই নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি নিজস্ব একটি প্রতিরোধ তৈরি করে ‘মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ লেলিয়ে দেওয়ার’ এই ঘৃণ্য প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তাহলে কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের নামে, পরকালের ভয় দেখিয়ে যে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস সারা পৃথিবীর সাধারণ শান্তিকামী মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে তাতে প্রতিটি ধর্মের দায় রয়েছে বিশেষ করে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জোশ-এ এই মুহূর্তে ইসলামই এগিয়ে রয়েছে এবং এক্ষেত্রে আমাদেরকে একথা প্রথমেই স্বীকার করতে হবে যে, মুসলিম হিসেবে আমাদের দায় ও দায়িত্ব রয়েছে এভাবে ধর্মকে ব্যবহারের রাজনীতির বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে।
কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আমরা প্রথমতঃ স্বীকারই করতে চাইছি না যে, ইসলামকে এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং দ্বিতীয়তঃ এটা বন্ধে একটা সামগ্রিক সংস্কার এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন রয়েছে, সেটা ধর্মাচরণে হোক কি ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই হোক। এটা না করা গেলে ভবিষ্যতে আপনার/আমার সন্তানের জন্য যে পৃথিবীকে আমরা রেখে যাচ্ছি তা কোনো ভাবেই তাদের জন্য নিরাপদ হবে না।
পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের দিকে তাকালে, মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি যে, ধর্ম ও ধর্মকে কেন্দ্র করে চলা রাজনীতি সেখানে কী ধ্বংস সাধন করেছে। বাংলাদেশ যেমন শ্রীলঙ্কার থেকে বেশি দূরে নয়, তেমনই বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকেও খুব বেশি দূরে নয়। আধুনিক পৃথিবীতে ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ না, বরং ধর্মের কারখানায় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের জন্ম হয়, আর তার অজুহাতে বিশ্বময় বেশুমার ঘৃণার চাষাবাদ চলে রাজনীতির নামে- এটা আমরা বুঝতে পারছি কিনা জানি না, কিন্তু বুঝলে আমাদেরই ভালো।
কলকাতা ২৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার ২০১৯
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/এমকেএইচ