নতুন সরকারের ১০০ দিন উদ্যমহীন, উৎসাহহীন ও উচ্ছ্বাসহীন ছিল-এমন মূল্যায়ন করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
Advertisement
নতুন সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে মঙ্গলবার সিপিডি আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ মন্তব্য করেন।
দেবপ্রিয় বলেন, ‘নতুন সরকার যখন নতুনভাবে আসে, তখন সে বিগত সময়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নতুন ধরনের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগটা তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। আমি মনে করি সাম্প্রতিক সময়ে যত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে) ইশতেহার সব থেকে সুচিন্তিত, সুলিখিত এবং সুগঠিত।’
তিনি বলেন, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে-কোনো রকম দুর্নীতি আমরা সহ্য করবো না। কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সেই দুর্নীতি প্রকটভাবে রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পরিবর্তনের, দিন বদলের। আর ওই বদলকে আটকে রাখছে এমন একটি গোষ্ঠী যারা এই দুর্নীতি থেকে সুবিধা ভোগ করছে। সুবিধাভোগী সম্প্রদায় যেটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে আছে, সেটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের শক্তিকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। এটাকে যদি সমাধান করা না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুগঠিত ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পাবে।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের বিগত ১০০ দিন আমরা একটি উৎসাহহীন, উদ্যোগহীন, উচ্ছ্বাসহীন এবং একই সঙ্গে উদ্যমহীন দেখেছি। অথচ আমরা আশা করে ছিলাম এটি একটি বড় ধরনের ১০০ দিনের উত্থানের ওপর প্রতিফলিত হবে। এটা আমরা লক্ষ্য করিনি। আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি গতানুগতিক ধারাবাহিকতা। নতুনভাবে সে রকম কিছু আমরা লক্ষ্য করিনি।’
‘বরং যে ধরনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি, সে ধরনের উদ্যোগ মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। মিশ্র ইঙ্গিত কী দিচ্ছে? আমরা লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ফলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হবে-এটা আমরা মনে করি না। মনে হয় যেন কোথাও সরকারকে একটি প্রথিত গোষ্ঠী করায়ত্ত করে নীতিনির্ধারণ করছে’ বলেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো।
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের যে ধারণা তার সঙ্গে নীতি প্রণয়নের ধারণার অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের যে ধরনের ভূমিকা সেটা আমরা দেখতে পারছি না। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতার জন্য যে ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের দরকার ছিল, সেগুলোর কিছু হয়নি। এই ১০০ দিনে আমরা আশা করেছিলাম অসঙ্গতিগুলো দূর করা যাবে। আমরা সে ধরনের সচেতনতাও দেখিনি, সে ধরনের পদক্ষেপও দেখিনি।’
জিডিপি প্রবৃদ্ধি গণনার পদ্ধতির সমালোচনা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখছি প্রবৃদ্ধি-নির্ভর অর্থনৈতিক আলোচনা। কেমন একটা প্রবৃদ্ধি আচ্ছন্নতা বা আকৃষ্টতা আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি। অথচ অর্থনৈতিক তত্ত্বের সাম্প্রতিককালের চিন্তা দেখলে দেখা যাবে, সকলেই বলবে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট না। এটা অর্থনীতি শাস্ত্রের দ্বৈতজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’
Advertisement
‘এজন্য মান উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালে জনগণের জীবনমানের বিভিন্ন সূচকের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ যে বৈশিক ঐক্যমত হয়েছে সেটিও প্রবৃদ্ধির বাইরে গিয়ে অনেক ধরনের পূর্ণাজ্ঞা উন্নয়নের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা প্রবৃদ্ধি-নির্ভর আলোচনা করি যেন, ওই পূর্ণাজ্ঞা উন্নয়নের আলোচনা আমাদের মনোযোগের বাইরে চলে না যায়। সাম্প্রতিককালে আমরা দেশের ভেতর অর্থনৈতিক আলোচনায় এটার (পূর্ণাজ্ঞা উন্নয়নের বিষয়) গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ দেখিনি’ বলেন দেবপ্রিয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি দেখি তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু, প্রশংসনীয় এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। তবে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাতে ব্যক্তিখাতের বাড়তি কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এই উন্নয়নের জন্য যে ধরনের কর আহরণ দরকার তা আমরা দেখলাম না। ব্যক্তিখাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা তা আমরা দেখলাম না। পুঁজিপণ্যের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকখাতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের চাঞ্চল্য থাকে তা-ও দেখলাম না। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে ধরনের চলক থাকে, সে চলকগুলোর প্রতিফল কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ছে না।’
‘যদি আমরা ধরি যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটা সঠিকভাবে অনুমিত হয়েছে। তাহলে বিনিয়োগ যেতেতু বেশি হয়নি, সুতরাং প্রবৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করতে হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি দেখাতে হবে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কী প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনীর রূপান্তর ঘটল যে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতা এমন বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেল! এটা আমাদের এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখতে হবে’ বলেন সিপিডির সম্মানিত এই ফেলো।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই প্রবৃদ্ধির অনুমিতি সঠিক হোক এবং সেটা থেকে যে ধরনের তাৎপর্য আসে সেটা যেন বাংলাদেশের নীতিকে সঠিকভাবে আগামীদিনে পরিচালিত করে। নীতিকে যেন বিভ্রান্ত না করে-কোনো ধরনের বিভ্রান্ত বা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে। এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।’
এমএএস/এসআর/এমকেএইচ