গ্রামজুড়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বসবাস। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে টিনের বেড়া। এখানে উঁচু তলার ভবন করার সামর্থ্য নেই কারও। কিন্তু গ্রামে ঢুকতেই শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি বিশাল দুটি অট্টালিকা নজর কাড়ে সবার। কাছে গিয়ে না দেখলে মনে হবে রাজপ্রাসাদ।
Advertisement
কথিত আছে, এই বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ১২ বছর। বর্তমানে কেউ এই বাড়িতে বসবাস করেন না। শুধু একজন কেয়ারটেকার আছেন দেখাশোনার জন্য।
বাড়ির মালিক সাখাওয়াত হোসেন টুটুল গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় এখন জেলে। বর্তমানে তার অবস্থান জানাতে পারেনি কেউই। বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের দেউলী সরকারপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল হাইয়ের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন টুটুল।
দেউলী সরকারপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, স্কুলজীবনে বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে বাড়ি ছাড়েন টুটুল। এরপর ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। সেখানেই লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করেন এক অবাঙালি নারীকে। এরপর থেকেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ঢাকার ধানমন্ডিতে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, গাজীপুর টাটকা ফুড প্রডাক্ট ফ্যাক্টরি, গ্রামের বাড়িতে একটি ইটভাটা এবং একটি কোল্ডস্টোরেজ ছাড়াও শতাধিক বিঘা আবাদি জমি রয়েছে টুটুলের। এছাড়াও অনেক ব্যবসা রয়েছে তার। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান টুটুল কীভাবে এত সম্পত্তির মালিক হলেন তা নিয়ে এলাকায় রয়েছে নানা আলোচনা ও রহস্য।
Advertisement
বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শিবগঞ্জ উপজেলার নিভৃত গ্রাম দেউলী। মহাস্থান মোকামতলা হয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দৃষ্টিতে আসবে এই বাড়িটি। এলাকার লোকদের কাছে বাড়িটি টুটুলের বাড়ি হিসেবে পরিচিত। মালিক টুটুল সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। বাড়ির পুরো সীমানাসহ প্রতিটি অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়েছে। দূর থেকে মনে হবে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। মূল ফটকটি নাটোরের উত্তরা গণভবনের নকশায় নির্মিত। ভেতরে চারতলা প্রাসাদের প্রথম ইউনিট ও দ্বিতীয় ইউনিটের ওপর চৌকোনা চারটি গম্বুজ উত্তরা গণভবনের মতো। মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই বাঁয়ে চোখে পড়বে শ্বেতপাথরের হংস ফোয়ারার চার ধারে পাথরের সান বাঁধানো পুকুর।
বাড়িটির প্রথম ইউনিটে বড় দরজা দিয়ে প্রবেশের পর বিরাট হল রুম। দেয়ালের পরতে পরতে নকশা। দ্বিতীয় ইউনিটে প্রবেশের পর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় নজরে আসবে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা)। প্রতিটি ফলকে প্রাচীন ইতিহাসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দোতলার ঘরগুলো সুপরিসর। এখানে ফাইভ স্টার হোটেলের লাউঞ্জ ও রিসিপসনিস্টদের মতো ডিজাইন করে রাখা হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ তলায় গিয়ে মনে হবে বিদেশি হোটেলের মতো যে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন সেখানে করা সম্ভব।
কাঠের জানালা-দরজাসহ প্রতিটি কাজই প্রাচীন নকশায় তৈরি। সবচেয়ে দামি কাঠ ব্যবহার হয়েছে এসব কাজে। শ্বেতপাথরও আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। প্রতিটি ঘরেই এয়ার কন্ডিশনার।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে হঠাৎ করে সাখাওয়াত হোসেন টুটুল তার পৈতৃক টিনের বাড়ির পাশে নতুন এই বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করেন। প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গা নিয়ে শুরু করেন বাড়ি নির্মাণের কাজ। শুরুতে প্রতিবেশীরা মনে করেছিলেন মাঝে মধ্যে গ্রামে এসে অবস্থান করার জন্য বিল্ডিং তৈরি করছেন। কিন্তু দেখা যায় ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের গাঁথুনি দিয়ে শুরু করা হয় নির্মাণকাজ। পাশাপাশি দুটি বিল্ডিং তৈরি করা হয়। নির্মাণ শেষে পুরো বাড়ি দুটি এবং সীমানা প্রাচীরে টাইলসের পরিবর্তে শ্বেতপাথর দেয়া হয়। এমনকি পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য তৈরি সেফটিক ট্যাংকের ওপরের অংশেও দেয়া হয়েছে শ্বেতপাথর। নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরাও এলাকার কেউ নন। ১২ বছর ধরে নির্মাণকাজ শেষে ২০১৮ সালে তা বসবাসের উপযোগী করে তোলা হয়।
Advertisement
একটি চারতলা, আরেকটি তিনতলা বাড়ির ছাদে রয়েছে চারটি করে গম্বুজ। প্রধান ফটকে রয়েছে চারটি গম্বুজ। দুটি বাড়ি ছাড়াও আলাদা আকর্ষণীয় ডিজাইনের রান্না ঘর, দুটি পুকুর, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিদের নিয়ে তৈরি করা একটি পার্ক এবং ফুলের বাগান।
বর্তমানে এ বাড়িতে কেউ বসবাস না করলেও প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে বাড়িটি একনজর দেখার জন্য। কিন্তু বাড়ির মালিক গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না।
কেয়ারটেকার জয়ন্ত কুমার জানান, অপরিচিত লোকজনকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। এজন্য বাড়ির সামনে প্রবেশ নিষেধ কথাটি লিখে রাখা হয়েছে।
এদিকে প্রতিদিন লোকজনের ভিড় হওয়ায় বাড়ির সামনে গড়ে উঠেছে একটি হোটেলসহ বিভিন্ন দোকান। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে দুদকের মামলায় গ্রেফতার হন সাখাওয়াত হোসেন টুটুল। এরপর থেকে বাড়ির ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সাখাওয়াত হোসেন টুটুল কারাগারে থাকার পর থেকে তার বড় ভাই ফজলুল বারি তার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করছেন।
ফজলুল বারি জানান, তিনি এসব ব্যাপারে কথা বলতে চান না। টুটুল কেন এত টাকা খরচ করে এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন তা পরিষ্কার নয়। তবে এটা ঠিক যে, এই বাড়ির কারণেই তাকে জেল খাটতে হচ্ছে।
দেউলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বলেন, টুটুল ভাই এলাকায় খুবই জনপ্রিয় মানুষ। এলাকার মানুষের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ান তিনি। কী কারণে বাড়ি তৈরি করা হয়েছে এ বিষয়ে তিনিও কিছু বলতে পারেননি।
লিমন বাসার/আরএআর/এমকেএইচ