বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্যতম লাভজনক রুট ঢাকা-লন্ডন- ঢাকা। অথচ গত এক মাসে এ রুটের ১৯টি ফ্লাইটের কোনোটিই সময়মতো ছেড়ে যায়নি। প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে বিলম্বিত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অর্থাৎ ২১০ মিনিট। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানের এমন আচরণে অতিষ্ঠ এ রুটের যাত্রীরা।
Advertisement
আরও পড়ুন >> শাহজালালে ম্লান বিমান প্রতিমন্ত্রীর অবদান
বিমান চলাচলের সময় পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত ওয়েবসাইট ‘এয়ারপোর্টিয়া’র তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা রুটে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালিত ৩০টি ফ্লাইটের প্রতিটি বিলম্বে উড্ডয়ন করেছে। ফ্লাইটগুলো গড়ে এক ঘণ্টা ৩৮ মিনিট করে বিলম্বে ছাড়ে। একইভাবে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরেও নির্ধারিত সময়ের এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছাচ্ছে ফ্লাইট। ফলে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে বিমানকে।
তবে বিমানের দাবি, নিয়মিত বিলম্বের তথ্য ঠিক নয়।
Advertisement
মিজান ওয়াহিদ শুভ নামে এক যাত্রী গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিমানের এ রুটের ফ্লাইটে চড়েন। লম্বা ফ্লাইটের প্রস্তুতি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে একটু আগেভাগেই আসেন তিনি। বিমানবন্দরে এসে জানতে পারেন, সকাল সোয়া ১০টার নির্ধারিত ফ্লাইট চার ঘণ্টা পর শাহজালাল ছাড়বে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ফ্লাইট দেরিতে ছাড়বে- এ বিষয়ে আমাদের আগে কোনো ম্যাসেজ কিংবা ই-মেইল করা হয়নি। এখানে এসে (বিমানবন্দর) অযথাই দেরি করানো হচ্ছে। শুধু মিজান নয়, ফ্লাইটটির অধিকাংশ যাত্রীর অভিযোগ, নিয়মিতই ফ্লাইটটি দেরিতে ছাড়ে। রাজধানীর লোকাল পরিবহনের মতো ‘যখনই ইচ্ছা হয় তখনই যাত্রা শুরু করে তারা’।
এ রুটের নিয়মিত যাত্রী জাকির খান। তিনি জানান, নিয়মিত দেরি করে ফ্লাইটটি। এমনও হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু আসার পর ২-৩ বারও সময় পরিবর্তন করে। দেরি হওয়ার কারণ জানতে বিমানবন্দরের কাউন্টারে কিংবা বিমানের স্টাফদের প্রশ্ন করা হলে, সদুত্তর দেয়া তো দূরের কথা, তারা ভালো মতো কথাই বলতে চান না। এক কথা দুবার জিজ্ঞাসা করলে বিরক্ত হন। তারা মানুষের সময়ের কোনো কদর করেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্যতম একটি লাভজনক রুট। সিলেট ও ঢাকার অনেকে নিয়মিত এ ফ্লাইটে লন্ডন আসা-যাওয়া করেন। ফ্লাইটটি প্রায় ১১ ঘণ্টায় সরাসরি লন্ডনে যায়। এ রুটের এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটে, কুয়েত, টার্কিশ ও গালফ এয়ারলাইন্সের সাড়ে ১৪ ঘণ্টা এবং কাতার এয়ারলাইন্স ১৫ ঘণ্টায় লন্ডন পৌঁছে। তবে বিমান বদলানোর ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ যাত্রী এ রুটের জন্য বিমান বাংলাদেশকে বেছে নেন।
আরও পড়ুন >> বাংলাদেশ বিমানের ফ্রি টিকিটে কোটি টাকার মালিক শফিকুল
Advertisement
পরিসংখ্যান বলছে, গত এক মাসে এ রুটে এমিরেটসের দুটি ফ্লাইট বিলম্বে ছাড়ে। অন্যদের পরিসংখ্যানটাও বিমানের মতো এত খারাপ নয়।
আতিক চৌধুরী নামের অপর এক যাত্রী বলেন, এ রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একমাত্র ডিরেক্ট (সরাসরি) ফ্লাইট পরিচালনা করে। তাই তারা যাত্রী বেশি পায় এবং দায়িত্বহীনভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করে। যদি অন্যকোনো এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে তাহলে বাংলাদেশিরাও বিমানকে ছেড়ে অন্য এয়ারলাইন্স ধরবে।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, বিলম্বে উড়োজাহাজ ছেড়ে শুধু বিমান নিজের ক্ষতি করছে না, শাহজালালের ফ্লাইট শিডিউল পরিবর্তনসহ রানওয়েও ব্যস্ত রাখছে। পৃথিবীর যেকোনো বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ছাড়ার কয়েক মাস আগে ফ্লাইট পরিচালনার সময়সূচি দিতে হয়। অথচ বিমান রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হয়েও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়মিত ফ্লাইট ওঠা-নামার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
ফ্লাইট পরিচালনায় বিলম্বের বিষয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ রুটে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি যাতায়াত করেন। তারা মাঝেমধ্যে দেরি করে ফেলেন। এ কারণে ফ্লাইট দেরিতে ছাড়ে। এটা শুধু লন্ডন রুটে নয়, সব রুটেই এমন ঘটনা ঘটে। এছাড়া অনেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় এসে ফ্লাইট ধরেন। তাদের ঢাকায় আসার ফ্লাইটগুলো বিলম্ব হলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনুরোধে এ রুটের ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হয়। কার্গোর মালামাল উঠা-নামায় অতিরিক্ত সময় ব্যয়েও ফ্লাইট বিলম্বের অন্যতম কারণ।
তবে মাঝেমধ্যে এ রুটে ফ্লাইট কেন বিলম্বিত হয়- তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কেউ।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা থেকে লন্ডনগামী ফ্লাইট সবসময় ডিলে (বিলম্বিত) হয়, এ কথা ঠিক নয়। এ ফ্লাইটের নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বিমানবন্দর ও এয়ারক্রাফটের ‘নিরাপত্তা বিবেচনায়’ লন্ডন ফ্লাইটের অ্যান্টি-হাইজ্যাক পয়েন্টে জোরালো তল্লাশির কারণে চার ঘণ্টাও সময় লেগে যায়।
একই চিত্র লন্ডনেও। বিমানের এ ফ্লাইট লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার সময়ও একই কাণ্ড ঘটায়। গত দেড় মাসে এ রুটে পরিচালিত ২৯টি ফ্লাইটের মধ্যে মাত্র একটি সময়মতো ছাড়তে পারে। এমনকি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ ঘণ্টা বিলম্বেও ছাড়ে একটি ফ্লাইট।
আরও পড়ুন >> বিমানের লন্ডন স্টেশনে এবার ডাবল কমিশন বাণিজ্য!
এখানেই শেষ নয়। ঢাকার ফেরার পথে সিলেটে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অবস্থান করে ফ্লাইটটি। সিলেট থেকে ঢাকায় আসতে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু মাঝেমধ্যে তিন ঘণ্টাও সময় লেগে যায়।
৪৫ মিনিটের পথের জন্য তিন ঘণ্টা কেন অপেক্ষা করতে হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘আমরা তো ইচ্ছা করে দেরি করি না। সিলেটে এক-দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে যাত্রীদের লাগেজ নামাতে। এ কারণে বিলম্বিত হয়।’
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা সরাসরি ফ্লাইটটি চালু হয়। সেসময় সপ্তাহে দুদিন এ ফ্লাইট চলাচল করত। বর্তমানে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট পরিচালিত হয়।
আরএম/এমএআর/পিআর