দেশজুড়ে

শিক্ষক-শিক্ষার্থী আছে, শুধু নেই ভবন

শিক্ষার্থী আছে। আছেন শিক্ষকও। নেই শুধু বিদ্যালয়ের ভবন, ক্যাম্পাস, চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। তবে থেমে নেই বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। নদী পার হয়ে, জলকাঁদা মাড়িয়ে আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়তে আসে শিক্ষার্থীরা। পাঠদান চলে গৃহস্থ বাড়ির বারান্দা, গোয়ালঘর কিংবা বেসরকারি সংস্থার অফিসের মেঝেতে! সেই ঘরের নেই দরজা-জানালা। বৃষ্টি হলেই মেঝেতেও লেখাপড়া সম্ভব না। আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি!এমনি একটি দুর্গম এলাকায় কোনোভাবে চলছে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠদান। আশপাশে নেই কোনো পানীয় জলের ব্যবস্থা। নেই শৌচাগার। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নে। অবিশ্বাস্য হলেও কিশোরগঞ্জের হাওরে নদী ভাঙনে ভবন ও জমি বিলীন হওয়ার পর দীর্ঘ তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম চং নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে শিক্ষা জীবনের প্রথম পাঠ নিচ্ছে কোমলমতি ২শ ২৮ জন শিক্ষার্থী। আর শিক্ষক আছেন ৪ জন ।কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার হাওর অধ্যুষিত সুতাপাড়া ইউনিয়নের ভাঙন কবলিত এলাকা চং নোয়াগাঁও। প্রমত্তা ধেনু নদীর তীরে ছিল চং নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে ভাঙনের তাণ্ডবে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। নদীর পেটে চলে যায় বিদ্যালয়ের জমিও। সেই থেকে বিড়ম্বনার শুরু।চং নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, ধেনু নদীর তীরে জরাজীর্ণ অবস্থায় স্কুলের কার্যত্রম চলছিল। নদীর ভাঙন এক সময় ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে হাত বাড়ায় স্কুলের পানে। ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতের বেলা নদীর প্রবল ঢেউ কেড়ে নেয় বিদ্যালয়ের পাকা ভবন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিলসহ সব উপকরণ। এ পরিস্থিতিতে সরকারি সহায়তায় স্কুলের পাশে নদীর পাড়ে বাঁশের মাচার ওপর একটি চালাঘর তৈরি করে চলছিল বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। কিন্তু কিছুদিন পর সেটিও উড়ে যায় কালবৈশাখী ঝড়ে।এদিকে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির বাড়ির বারান্দা, গোয়ালঘর এবং বাড়ি সংলগ্ন একটি বেরকারি সংস্থার অফিসের মেঝেতে চালানো হচ্ছে এর শিক্ষা কার্যক্রম। দীর্ঘ তিন বছরেও বিড়ম্বনার হাত থেকে মিলছে না মুক্তি।সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বদ্ধ জলাশয়ের ওপর নির্মিত `রাঙামাটি খাল ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার অফিসের মেঝেতে বসে ক্লাশ করছেন দুই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। ঘরটির দৈর্ঘ্য ৪০ ফুট আর প্রস্থ ২০ফুট। ঘরের দরজা-জানালা নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোট্ট এক চিলতে মেঝেতে এক সঙ্গে গাদাগাদি করে বসতে হয় প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া কোমলমতি শিশুদের।বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসি, মাহিন, নার্গিসসহ অন্যান্য শিশুরা জাগো নিউজকে জানান, বর্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে এবং সাঁতরে তাদের বিদ্যালয়ে আসতে হয়। অনেক সময় ঘটে নৌকাডুবি। তখন ভেজা কাপড় নিয়েই তাদের ক্লাশ করতে হয়। তবে বৃষ্টি হলে মেঝেতেও পানি জমে যায়। তখন আর লেখাপড়া সম্ভব হয়ে উঠে না। চং নেয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মো. আতা এলাহি জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ভবন না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীরা অমানবিক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। দূরর্দরান্ত থেকে তারা অস্থায়ী স্কুলে পড়তে আসে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী-খাল-বিল পার হয়ে তাদের এখানে আসতে হয়। অথচ স্কুলের নামে এক গ্রামবাসী জমি লিখে দিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় স্কুলের ভবন নির্মাণ করা যাচ্ছেনা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, আবহাওয়া ভালো থাকলে বাড়ির উঠান ও একটি গোয়াল ঘরে ক্লাশ নেয়া হয়।বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি চং নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা হাজী মো. ওয়াহেদ আলী ভূঁইয়া জাগো নিউজকে জানান, আগে যেখানে বিদ্যালয় ভবন ছিলসে জমিটি তিনি দান করেছিলেন। সেটি নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেলে তার বাড়ির পাশে নতুন করে ৩০ শতাংশ জমি লিখে দেন। কিন্তু নানা জটিলতায় দীর্ঘ ৩ বছরেও নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ হচ্ছে না।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬৬ সালে ৯৩ শতাংশ জমি নিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮  সালে নদীর ভাঙনে বিদ্যালয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এ সময় ভাঙন কবলিত হওয়ায় পার্শ্ববর্তী স্থানে স্কুল ভবন নির্মাণে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিদ্যালয়ের জমিদাতা হাজী ওয়াহেদ আলী ভূঁইয়া সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালে আদালতে মামলা করেন। আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞাসহ আগের জায়গায় বিদ্যালয় স্থাপনের আদেশ দেন। এতে আটকে যায় নতুন ভবন নির্মাণ। আগের জায়গা এরই মধ্যে চলে যায় নদীগর্ভে। পরে ওয়াহেদ আলী ভূঁইয়া বিদ্যালয়ের জন্য নতুন করে আরো ৩০ শতাংশ জমি দান করেন। একই সঙ্গে নতুন জমিতে বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি চেয়ে তিনি আদালতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নতুন জমিতে বিদ্যালয় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়।কিন্তু ২০০১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বিদ্যালয়ের আগের স্থানে বিদ্যালয় কাম বন্যাশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন। এর সূত্র ধরে ২০১২ সালে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য এলজিইডির অর্থায়নে ৪১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু বিপত্তি যেনো কিছুতেই কাটছে না। উল্লেখিত স্থানে ভবন নির্মাণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গোলাম মাওলা জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যালয় ভবনটি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটি নতুন ভবন নির্মাণের চেষ্টা চলছে। তবে নানা জটিলতায় ভবন নির্মাণ সম্ভব হচ্ছেনা। তিনি জানান, বিদ্যালয়টি স্থানান্তর ও পুনর্নির্মাণে জটিলতাসহ বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ করে সর্বশেষ গত ২৭ আগস্ট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এসএস

Advertisement