‘তুমি কত দূর পড়াশোনা করেছ? বিদেশে উচ্চতর ট্রেনিংয়ে যেতে চাও? আমি সুযোগ করে দেব। বিদেশে গেল আমাকে ‘পার্টনার’ হিসেবে নিও। ‘বাবার বয়সী হয়েও তিনি আমাকে বিছানায় পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে তার সঙ্গে হোটেলে থাকার কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে তার কক্ষে ডেকে প্রস্তাবে রাজি হলে চাকরিতে প্রমোশন, টাকা-পয়সা, গয়না, বাড়ি-গাড়ির অভাবে হবে না বলতেন। প্রয়োজনে বিয়ে করে মাল্টিপল ভিসায় ইউরোপ-আমেরিকায় নিয়ে যেতে রাজি- এমন কথা বলে দিনের পর দিন মানসিক ও যৌন নিপীড়ন মূলক আচরণ করেছেন। তার অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। সুইসাইড নোটও লিখেছিলাম। কিন্তু স্বামী-সন্তানদের কথা ভেবে তা করতে পারিনি। কিন্তু যেদিন তিনি কক্ষে ডেকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন, সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম তার মুখোশ খুলে দিতে একলা হলেও যুদ্ধ করব।’
Advertisement
রাজধানীর উত্তরায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের পরিচালক আমিরুল হাসানের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানির অভিযোগকারী নার্স আজ (শুক্রবার) জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। বর্ণনা দিতে গিয়ে তার কণ্ঠ থেকে কখনও ক্রোধ, কখনও অসহায়ত্ব আবার কখনও দৃঢ়চেতা মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছিল।
ওই নার্স জানান, আমিরুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় কর্মস্থলে নানাভাবে হয়রানিসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে তিনি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
তিনি আরও জানান, বিকৃত রুচির ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার চেয়ে নার্সিং অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠন কিংবা তার বক্তব্যে জানতে কারও কাছ থেকে চিঠি পাননি। এ ব্যাপারে তিনি থানায় জিডি করেছেন।
Advertisement
ঘটনা প্রবাহ : নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নার্স জানান, তার মূল কর্মস্থল রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় যক্ষা (টিবি) হাসপাতালে। ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সেখান থেকে ডেপুটেশনে উত্তরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে যোগ দেনে। একই বছরের ৪ নভেম্বর আমিরুল হাসান সেখানে পরিচালক পদে যোগদান করেন।
ওই নার্স জানান, ‘পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর জরুরি বিভাগসহ হাসপাতালে রাউন্ড দেয়ার সময় আর দশজন নার্সের মতো তার সঙ্গেও দু’চারবার কথাবার্তা হয়। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তিনি নানা অজুহাতে আমাকে তার কক্ষে ডাকতেন। শুরুর দিকে কুশল বিনিময়, ঘর সংসার, স্বামী ও সন্তান সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। কিন্তু পরবর্তীতে কথাবার্তায় বিয়ের প্রলোভন, দেশবিদেশের হোটেলে তার সঙ্গে রাত্রিযাপনসহ নানা অশুভ ইঙ্গিত দিতে শুরু করেন।’
‘একদিন তাকে টেলিফোনে জরুরি বিভাগের রোগীদের পরিসংখ্যান জানতে তার কক্ষে ডেকে পাঠান। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে এক পর্য়ায়ে বলেন, ‘তোমাকে তো আগেই হালকা টাচ দিয়েছিলাম। এখন বলছি শোন, তোমার সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতেচাই।’
তিনি (নার্স) তখন বলেন, স্যার আপনি আমার বাবার বয়সী। আমার ঘর-সংসার আছে, আপনারও আছে। এমন প্রস্তাব কী করে দিচ্ছেন।’
Advertisement
এ সময় তিনি (পরিচালক) লেখক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে মেহের আফরোজ শাওনসহ বেশ কয়েকজনের অসম বয়সের প্রেমের উদাহারণ তুলে ধরে বলেন, ‘প্রয়োজনে তোমাকে নিয়ে বিদেশে চলে যাব। তোমার সঙ্গে বাকিটা সময় কাটাতে চাই।’
‘এরপর থেকে তাকে যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি ততই তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে আরও নানা প্রলোভন দিতে থাকেন। একদিন নিজের অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে তিনি জানতে চান প্রস্তাবের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অসম্ভব বলতেই তিনি বলে ওঠেন, ‘প্রস্তাবে রাজি হলে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব হবে না। চাইলে দেশের যে কোনো স্থানে থাকতে পারবেন, চাইলে মাল্টিপল ভিসা লাগিয়ে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোনো দেশে থাকতেও আপত্তি নেই।’
এক পর্য়ায়ে বিষয়টি নার্সিং সুপারভাইজারকে জানিয়ে প্রতিকার চান। নার্সিং সুপারভাইজার এ নিয়ে পরিচালক ও অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পান। এরপর তিনি লিখিত অভিযোগ জমা দিলে নার্সিং সুপারভাইজার তা নার্সিং অধিদফতরে পাঠান। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে পরিচালক তাকে বদলি করে দেন।
ওই নার্স আরও জানান, শুরুর দিকে তিনি বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সুরাহার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। কিন্তু আমিরুল হাসানের একগুয়েমির কারণে তিনি থানায় নিজের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি ও সংশ্লিষ্ট সব দফতরে অভিযোগ দায়ের করেন।
এ ব্যাপারে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, অভিযোগটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়। তবে একজন পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ তাদের জন্য বিব্রতকর।
এদিকে অভিযুক্ত আমিরুল হাসান গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে নিজের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর কাজে ওই নার্সকে ব্যবহার করছেন। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনে তাকে পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে অন্য কাউকে সেখানে নিয়োগ দিতে চাইছে। তিনি ওই নার্সকে কখনও এ ধরনের কোনো প্রস্তাব দেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা হচ্ছে ষড়যন্ত্র, অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। মেয়েটি কেনো আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে তার কারণ আমি জানি, আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। আমার বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ করার জন্য একটি গ্রুপ তাকে ২০ লাখ টাকা ও একটি গাড়ি দিয়েছে। সে এখন ওই গাড়িতেই ঘুরে বেড়ায়। ওই গ্রুপটি হাসপাতাল ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাকে ব্যবহার করছে।’
এমএমজেড/পিআর