অব্যাহত দরপতনে একটু একটু করে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। পতন ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। উল্টো গাড়ি বিলাসে মেতেছেন ডিএসইর শীর্ষ ব্যক্তিরা।
Advertisement
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও)-এর জন্য কেনা হচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ি। ইতোমধ্যে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ সংক্রান্ত অনুমোদনও নেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন > প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলেন আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানের জন্য কেনা হচ্ছে দেড় কোটি টাকা মূল্যের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ি। সিআরও এ কে এম জিয়াউল হাসান খান ও সিএফও আবদুল মতিন পাটওয়ারীর জন্য কেনা হচ্ছে অর্ধ কোটির বেশি মূল্যের নিশান এক্স-ট্রেইল।
Advertisement
এমডি, সিআরও ও সিএফও’র জন্য যে গাড়ি রয়েছে তা বেশ পুরোনো- এমন কারণ দেখিয়ে ডিএসইর ৯১৪তম বোর্ড সভায় তিনটি নতুন গাড়ি কেনার অনুমোদন নেয়া হয়। এর মধ্যে এমডির গাড়ির জন্য বাজেট ধরা হয় দেড় কোটি টাকা। আর সিআরও ও সিএফও’র গাড়ির জন্য বাজেট ধরা হয় ৫৫ লাখ টাকা করে। এ বাজেটের ওপর ভিত্তি করে এমডির জন্য এক কোটি ৪৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা এবং সিআরও ও সিএফও’র জন্য ৫৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মূল্যের গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য এমন বিলাসবহুল গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রায় তিন মাস ধরে চলা অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে বাস্তব কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি ডিএসই। ফলে দিনের পর দিন দরপতনের কবলে পড়ে পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারের ওপর চরম আস্থাহীনতার সঙ্গে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। লেনদেন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
১০ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা তিন কার্যদিবস লেনদেন হয়েছে তিনশ কোটি টাকার নিচে। ১৪ মার্চের পর গত এক মাসে ডিএসইর লেনদেন পাঁচশ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি।
এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এমডি, সিআরও ও সিএফও’র জন্য গাড়ি কিনতে যে টাকা খরচ হচ্ছে তা আমাদের টাকা। বাজারের চরম মন্দাভাবের কারণে ব্যবসা কীভাবে টিকিয়ে রাখব, কর্মকর্তাদের বেতন কীভাবে পরিশোধ করব, সারাক্ষণ সেই চিন্তা করতে হচ্ছে আমাদের। আর ডিএসইর শীর্ষ ব্যক্তিরা আমাদের টাকা দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার পায়তারা করছেন! কিন্তু বাজারের মন্দাভাব কাটাতে ডিএসইর পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ বাজার উন্নয়নের জন্য ক্ষেত্র-বিশেষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে ডিএসইর ভূমিকা বেশি থাকার কথা।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ডিএসইর বর্তমান ম্যানেজমেন্টের কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়, বাজার সম্পর্কে তাদের দক্ষতার বেশ অভাব আছে। এরপরও প্রভাবশালী সদস্যদের হাত করে তারা তাদের পদ ধরে রেখেছেন। এমনকি সিআরও, সিএফও’র পদ দুটি চুক্তি-ভিত্তিক হলেও তারা তা স্থায়ী করে নিয়েছেন। বিভিন্ন সময় ডিএসইর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রজেক্টের নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং অবৈধভাবে শেয়ার ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ওই সদস্য বলেন, ডিএসইতে আসলে কী হচ্ছে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দ্রুত খতিয়ে দেখা উচিত। ডিএসই ঠিক না হলে পুঁজিবাজার ঠিক হবে না। এ বাজারের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নেও পুঁজিবাজারের ভূমিকা রয়েছে। তাই লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের উচিত দ্রুত ডিএসইর কার্যক্রম খতিয়ে দেখা।
আরও পড়ুন > আলো দেখিয়ে অন্ধকারে পুঁজিবাজার
ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ খান ২০০৩ সালে যখন ডিএসইর সিইও হিসেবে আসেন তখন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি টাকার মতো। তার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ২০০৮ সালে লেনদেন ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়। কিন্তু ২০১০ এর ধসের পর মার্কেট আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, শুধুমাত্র অদক্ষ ম্যানেজমেন্টের অযোগ্যতার কারণে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১৩ ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী মালিকানা ব্যবস্থাপনা আলাদাকরণ হলেও মার্কেটের উন্নতির জন্য নেয়া হয়নি তেমন কোনো পদক্ষেপ। উল্টো ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী যে ম্যানেজমেন্ট ডিএসইতে এসেছে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত ছিল। মার্কেটের ব্যাপারে তারা ছিল বরাবরই উদাসীন। ফলে বাজারে যেমন গতি আসেনি, তেমনি সময়ে সময়ে লেনদেনে দেখা গেছে মহাখরা। অথচ ২০০৮ সালের তুলনায় এখন তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ লেনদেনের পরিমাণ না বেড়ে উল্টো কমছে।
ডিএসইর অপর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের পর ম্যানেজমেন্ট ডিএসইকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। উল্টো ডিএসইর সদস্যদের সাময়িক খুশি করার জন্য বছরের পর বছর রিজার্ভ ভেঙে লভ্যাংশ দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ফান্ড সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ বছর ডিএসই নিকুঞ্জের নিজস্ব ভবনে যাওয়ার কথা। সেখানে গেলে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে মার্কেটের গতি বাড়াতে না পারলে ডিএসইর আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হবে।
তিনি আরও বলেন, ডিএসইতে অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করে বর্তমানে একজন জিএম পদে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ শেয়ার ব্যবসার অভিযোগও ওঠে। উত্তরায় তার একাধিক বাড়ি আছে। সম্প্রতি সাভারে একটি কারখানা চালু করেছেন। তার নামে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) মামলা হয়েছিল। এরপরও তিনি দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এমন অবস্থার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে ডিএসই।
সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন জগো নিউজকে বলেন, পুঁজিবাজারের বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনার জন্য ডিএসইর পক্ষ থেকে বিএসইসিতে মতামত দেয়া হবে। তবে ডিএসইর এমডি, সিআরও ও সিএফও’র জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আরও পড়ুন > বিএসইসির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কারসাজি চক্র
তিনি আরও বলেন, বাজারে আস্থার জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। বাজারে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। সেই পরিবর্তনগুলো আনার জন্য বিএসইসিতে মতমত দেয়া হবে।
‘আইপিও যেভাবে আসছে সে ব্যাপারে আমাদের অনেক আপত্তি আছে। প্লেসমেন্টের বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। এমন অনেক বিষয়েও আমাদের আপত্তি আছে। এগুলো আমরা বিএসইসিকে জানাব।’
বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বাজারের মন্দাভাবের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন পুঁজি হারাচ্ছেন। নিঃস্ব হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আত্মহত্যা করছেন। আর ডিএসইর এমডির জন্য কেনা হচ্ছে দেড় কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি।
‘ডিএসইর এমডি বাজারের জন্য কী করেছেন? উনি তো নিজের স্বার্থ হাসিলের পায়তারা চালাচ্ছেন। ইস্যুয়ারদের পক্ষে দালালি করছেন এবং বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন। অথচ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা ডিএসইর অন্যতম দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তো ডিএসইকে পালন করতে দেখছি না।’
এমএএস/এমএআর/জেআইএম