মতামত

দেশে রাজনীতি আছে, রাজনীতি নেই

প্রতিদিন সকালে হাঁটতে যাই রমনা পার্কে। সেখানে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কিছু কথাও হয়। যারা আমার পরিচিত, যারা জানেন যে, আমি সংবাদপত্রে কাজ করি তারা আমার কাছে খবর জানতে চান।

Advertisement

খবর মানে সংবাদপত্রে, অনলাইনে বা টেলিভিশনে যেসব খবর প্রকাশ বা প্রচার হয় সেগুলো নয়। তার বাইরের বিশেষ কিছু খবর। যাকে হাঁড়ির খবর বা ভেতরের খবর বলা হয়। আমি সবাইকে হতাশ করি। তাদের আমি কোনো বিশেষ খবর দিতে পারি না। ভেতরের কোনো খবর আমি জানি না। সাংবাদিকরা সাধারণত যে খবর জানেন, আমি তা-ও জানি না। কারণ বিশেষ খবর জানার কোনো কৌতূহল আমার নেই।

পহেলা বৈশাখের পরের দিন রমনায় দেখা হলো একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে। তিনি এক সময় মন্ত্রী ছিলেন। এখন নেই। তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। তবে চৌদ্দ দলের শরিক দলের নেতা। তো, এই নেতাও আমাকে দেখে প্রথমেই খবর জানতে চান, কী হচ্ছে দেশে? দেশের রাজনীতি কি ঠিক পথে আছে?

কী জবাব দেবো এই প্রশ্নের? তবু কিছু একটা বলার জন্যই বললাম, খবর তো সব ভালো। সব কিছু ঠিকঠাক মতোই তো চলছে। এটুকু বলে আমি পাল্টা জানতে চাই, খবর তো আপনাদের কাছে। আপনারা খবর তৈরি করেন। আপনারা দেশ চালান। দেশ ঠিক মতো চলছে কিনা সেটা তো আপনি বলবেন।

Advertisement

এবার নেতা একটু থতমত খেয়ে কষ্টের হাসি হেসে বললেন, না, হ্যাঁ, ঠিকই তো আছে। তারপর একটু উদাসভাবে বললেন, আসলে দেশে রাজনীতি নেই। ৩০ ডিসেম্বরের আগের বাংলাদেশ আর ৩০ ডিসেম্বরের পরের বাংলাদেশ এক নেই।

আমি বলি, এক নেই কেন? আমি তো দেখছি একই আছে। আগেও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা, পরেও তিনি। পরিবর্তন এটুকুই যে, আগে ছিল মহাজোটের সরকার, এখন আওয়ামী লীগের একক সরকার। তিনি বলেন, সমস্যাটি এখানেই। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে – এটা জানা ছিল, প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু বিএনপি ছয় আসনে জিতবে এটা কারো কল্পনায়ও ছিল না। বিএনপিকে মানুষ ভোট দেবে না, ক্ষমতায় আনবে না, এটা জানা থাকলেও মনে করা হচ্ছিল যে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির আবির্ভাব ঘটবে।

আগের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে সংসদীয় রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়েছিল। এবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা আবার সংসদীয় ধারায় ইন করবে। কিন্তু সব কিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেল যে, কেউ আর কোনো হিসাব মেলাতে পারছেন না। এই হিসাব না মেলানোর রাজনীতি কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।

আমি জানতে চাই, কীভাবে নির্বাচনে এমন অভাবিত ফলাফল ঘটলো, সেটা কি আপনারা পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন? চৌদ্দ দলে কী এনিয়ে কোনো আলেচনা হয়েছে? তিনি জবাব দিলেন না। তার নীরবতা থেকে আমি বুঝলাম, এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না।

Advertisement

একটু চুপ থেকে তিনি অবশ্য বললেন যে, দুর্বল বিরোধী দল থাকলে সরকার হয়তো স্বস্তিবোধ করে ,সরকারের ওপর কোনো চাপ থাকে না। কিন্তু তাতে সারাক্ষণ একটি অনিশ্চয়তার শঙ্কা থাকেই। কখন কী হয়, কোন দিক দিয়ে ঝড় ওঠে তা নিয়ে উদ্বেগ থাকে।

আপনার মনে কি কোনো ভয় কাজ করছে? জানতে চাইলে আবারো কষ্টের হাসি হেসে তিনি বললেন, না, ভয় নয়। তবে এখন সরকারকে চলতে হবে অনেক সতর্কভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর এখন অনেক চাপ। তাকে মূলত একাই সব কিছু সামাল দিতে হচ্ছে। এটা খুব কঠিন কাজ। একটি দেশে রাজনীতি থাকা ভালো। না থাকা ভালো নয়। আমরা যে একটি রাজনীতিহীনতার পথে ধাবিত হচ্ছি এটা কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।

দেশ চলছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে,তাকে কেন্দ্র করে। তিনি দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তার টিমমেটরা তার সঙ্গে দৌড়ে পারছেন না। এই অবস্থাটা কাটাতে হবে। ভবনে আগুন লেগে মানুষ মারা গেলে প্রধানমন্ত্রীকেই তার তত্ত্বতালাশ করতে হবে, দুর্বৃত্তরা নির্যাতন করে কোনো নারীকে পুড়িয়ে মারলেও প্রধানমন্ত্রীকেই ভূমিকা রাখতে হবে, এটা কি কোনো স্বাভাবিক কার্যক্রম হতে পারে?

বিএনপি সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বিএনপি যতো সংকটে জড়িয়ে পড়েছে তা রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে বিএনপির যে জায়গা তা কি শূন্য থাকবে? নাকি ওই শূন্যস্থান পূরণে কোনো নতুন শক্তির আবির্ভাব হবে?

আমি ওই নেতার কাছেই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই। তিনি বলেন, সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও নেই। তবে তিনি হতাশ না হওয়ার পক্ষে এবং কোনো ধরনের কাল্পনিক বিপদের কথা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা অনুচিত বলেও তিনি মনে করেন।

রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বিদায় নেওয়ার আগে বললেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি যদি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যদি সরকারের দৃঢ় ভূমিকা দেখা যায় তাহলে অনেক কিছুই সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে শেখ হাসিনার দক্ষতার তুলনা নেই। ক্রাইসিস যাতে তৈরি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে সবাইকে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম