‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ দেশ মাতৃকার মাটির টানে, স্বাধীন দেশের বাসনায় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে দেশের সোনার সন্তানেরা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের বুকের তাজা রক্ত। নিঃশেষে করেছেন দান সবুজ সতেজ প্রাণ। কৃতজ্ঞ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
Advertisement
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সাধনায় কালে কালে ঘটেছে বহু বিদ্রোহ। ফরাজী আন্দোলন থেকে শুরু করে সিপাহী বিদ্রোহ, নীল চাষিদের নীল বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, মাস্টাদার স্বদেশী আন্দোলনসহ ছোট বড় নানা অনেক বিদ্রোহ। একটি সুন্দর, সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী এবং পাকিস্তানি হানাদারবিরোধী আন্দোলনে সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের চেতনার প্রতিফলন আমাদের মহান বিজয়।
কালজয়ী ঐতিহাসিক পুরুষ লাল-সবুজ পতাকার স্বপ্ন নির্মাতা স্বাধীন বাংলার প্রবাদ ব্যক্তিত্ব সর্বযুগের উদ্ভাসিত সৈনিক চট্টলার অহংকার তথা দক্ষিণ রাউজানের সূর্য সন্তান মাস্টারদা সূর্যসেন। মাস্টারদা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একজন বিপ্লবী হিসেবে আমাদের সামনে একটি প্রতিবাদী ভাষা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ‘চট্টগ্রাম বিদ্রোহ’ জাগ্রত গণচেতনার প্রতিফলন। গণবিদ্রোহের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে অঙ্গীকার করে ঘটেছিল এর সূচনা। সকল বিপ্লবী এক নিশানের নিচে ছিল সমবেত। সকলের মূলমন্ত্রও ছিল এক। আর সূর্যসেনই সেই বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক।
১৯১৮ সালে সূর্যসেন নগেন সেন, অনুরূপ সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, চারু বিকাশ দত্ত এই বিপ্লবী দলের উদ্বোধন করেন। ১৯২০ সালে সাম্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈপ্লবিক প্রস্তুতির শুরু। ১৯২১ সালে এক দল যুবকদের নিয়ে সূর্যসেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। এরপর ১৯২৮ সালে কংগ্রেসে যোগদান এবং পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
Advertisement
রিপাবলিকান আর্মি গঠনের মধ্যে দিয়ে ১৯৩০ সালের ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল মাত্র একান্নজনের বিপ্লবী দল নিয়ে পাহাড়তলী ও দামপাড়া অস্ত্রাগার দখল এবং ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের ন্যাশনাল স্কুলের গণিতের শিক্ষক সূর্যসেনের মুক্ত ও স্বাধীন ভারত ছিল একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। তাইতো আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশদের এদেশ থেকে তাড়াবার জন্য মাস্টারদা প্রাণের বিনিময়ে একটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তুলে ছিলেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছিল সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের কণ্ঠ থেকে। চট্টগ্রামকে তিনদিন স্বাধীন রেখেছিলেন তিনি।
স্বার্থান্বেষী কিছু গোষ্ঠী মাস্টারদার স্বদেশী আন্দোলনকে আজো সাম্রাজ্যবাদীতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্যবাদী বলে নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। তার আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, দেশজোড়া তার ভাতৃত্ব বোধকে হিন্দুয়ানী আন্দোলন বলে ফলাও করে যাচ্ছে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ। অথচ মাস্টারদার ডাকে, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ব হয়ে মা ও মাটির সোঁদা গন্ধে মত্ত পেশিবহুল মুলসমানদের মধ্যেও তখন বিদ্রোহের আলো জ্বলে উঠেছিল।
সূর্য সেনের প্রথম দশজন সহকর্মীর অন্যতম বিপ্লবী আফসার উদ্দিন, চট্টগ্রামের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব শেখ-ই- চাটগাঁম কাজেম আলী মাস্টার, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, পোপাদিয়ার মীর আহমদ, আব্দুস সত্তার, লোকমান খান শেরওয়ানি, কেরালভাঙ্গার আব্দুল হক, কামাল উদ্দিন, শ্রীপুরের নূর আহমদ, পাঁজচখাইনের আমির হোসেন, কদুর খিলের নওয়াব মিয়া, মিরসরাইয়ের কবি ইব্রাহিম ও সৈয়দুল হক সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী দলে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মেয়েদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত করেন বিপ্লব প্রেমিক অমর শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার ও কল্পনা দত্ত। তাদের টানে অনেক মেয়েরাও এগিয়ে এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিশেষত কল্পনা দত্তের আর্কষণে অনেক মুসলিম মেয়ে অন্ধকার থেকে আলোকে এসেছিলেন যাদের মধ্যে আয়েশা বাণুর নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বিপ্লবী নারী সাবিত্রী দেবী, ইন্দুমতী সিংহ, সুহাসিনী গাঙ্গুলি, কুন্দ্রপ্রভা সেনগুপ্তার নাম অনির্বাণ।
Advertisement
১৯৩৩ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি পটিয়া থানার গৈরালা গ্রামের আশ্রয় ঘাঁটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আতঙ্ক মাস্টারদা সূর্যসেন ধৃত হন ব্রিটিশ বাহিনী দ্বারা। অতঃপর ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা, বাংলা স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসিতে আত্মাহুতি দেন।
দেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক তাদের জীবন কোরবানি দিয়েছেন তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রাখতে, সকল বিভেদ ভুলে একসাথে মুক্তির নেশায় কাজ করতে, প্রিয় সংগঠন রিপাবলিকান আর্মি যাতে বিভাজন না হয় তার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় বাণী রচনা করেছেন মাস্টার দা। ফাঁসির পর সূর্য সেনের লাশ তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পর লাশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হয়নি। কোথায় কি করেছিল তা এখনও ঠিক জানা যায়নি।
তবে বিভিন্ন সূত্র মতে জানা যায়, ব্রিটিশ ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ ‘দি রিনাউন’ এ করে বঙ্গোপসাগরে পাথর বেঁধে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল শক্তিমান পুরুষ সূর্য সেনকে। কি দুর্ভাগা উত্তরসূরি আমরা। কি নির্মম ভাগ্য আমাদের। আমাদের পূর্বপুরুষ, মুক্তির অগ্রদূত, পথিকৃত, ভারত উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালির বাঙালি সত্তা সূর্যসেনের পায়ে সামান্য পুষ্পার্ঘ অপর্ণের সৌভাগ্যটুকুও আমাদের নেই।
অন্তত সঠিক তথ্য উদঘাটনের মধ্যে দিয়ে সামান্য স্বীকৃতিটুকুও আমরা দিতে পারছি না তার অবদানকে, তার আত্মত্যাগকে। এ আমাদের বড় ব্যর্থতা, বড় গ্লানি। নিশ্চয়ই বিচক্ষণ মহাত্মা সূর্য সেন ঠিক বুঝতে পারছেন আমরা আসলে বড্ড অহসায়। আমরা ক্ষমা প্রার্থী!
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল কালের প্রবাহে আজ সুদীর্ঘ অতীত। চট্টগ্রাম অভ্যুথান, সূর্যসেনের আত্মত্যাগ আজও আমাদের ভাবিত করে আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য প্রেরণার সন্ধানে, ইতিহাস চেতনার উদ্ভাবনে। পরাধীনতার হাত থেকে ভারতবাসীকে স্বাধীন করার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রজ্বলিত যোদ্ধা সূর্যসেন বুকের যন্ত্রণাকে লাঘব করেছিলেন ফাসিঁর মঞ্চে গিয়ে।
শ্রদ্ধাভরে আজ তাই স্মরণ করছি আমাদের সেই মহান বিপ্লবী নেতাকে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্ম নিক মাস্টারদার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হাজারো অগ্নিপুরুষ। সাম্রাজ্যবাদীতা, পরাধীনতার ছোবল থেকে মুক্তির সূর্যালোক উদ্ভাসিত হবে যুগে যুগে। আর সে সব যুদ্ধে, সংগ্রামে আর বিপ্লবে অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়ে যাবে মাস্টারদা দিনের প্রথম সূর্য হয়ে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, বন্দে মাতরম, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক!
লেখক, কলামিস্ট
এইচআর/জেআইএম