মতামত

ফেনী-নারায়ণগঞ্জ: রোড টু ডেমোক্রেসি

ফেনী আর নারায়ণগঞ্জ বরাবরই আলোচনার টপলিস্টে। জেলা দুটির সামাজিকতার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রুপ-চেহারা ভিন্নরকম। অন্যসব জায়গার সঙ্গে এর প্রেক্ষিতও ভিন্ন। অনেক অমিল। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় না এলেও অন্য কোনো ইস্যুতে আলোচনায় জ্যান্ত থাকতো ফেনী। সেখানে নানা ঘটনায় রাজনৈতিক তথা প্রভাবশালীদের সম্পৃক্তাও ভিন্নমাত্রার। যা দেখা গেছে কলেজ প্রিন্সিপাল সিরাজউদ্দৌলাকে আদালতে বেকসুর প্রমাণের চেষ্টার মধ্যেও।

Advertisement

আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের আইনজীবীরা একসঙ্গে তার জন্য নেমেছেন কোমর বেঁধে। সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিনসহ ১২ জন বিভিন্নদলের হলেও নুসরাতকে পুড়িয়ে মারায় ছিলেন একাত্ম। এ ধরনের কাজে ব্যাপক ঐক্য ও গণতন্ত্র তাদের মধ্যে। যার সুবাদে মেয়েটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা কেউ দেখেনি। গায়ে আগুন নিয়ে দোতলা থেকে তার নিচে নেমে আসা, বাঁচার আকুতিতে চিৎকার শোনেওনি। ফেনীর সামগ্রিক অবস্থা উপলব্ধির জন্য সেখানে একসময় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানার জবানীটি সংগ্রহে রাখার মতো। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া তার বর্ণনাটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো...। আপনারা সবই জানেন, তাও বলি, সত্য সূর্যের মতই ...সোহেল রানা দিনে দুপুরে ছিনতাই হয়েছে বিজয়সিং দিঘীতে৷ ছিনতাইয়ের শিকার যুবকের করা মামলা নেয়নি ওসি রাশেদ চৌধুরী। মামলা নিতে চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে। তারপরও নেয়নি মামলা। এরপর, অন্তত ১০টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আমি থানায় পাঠিয়েছি ভিক্টিমদের। ওসি মামলা নেয় নাই। জিডি করতে বাধ্য হয়েছে ভিক্টিমেরা। আমার জিজ্ঞাসা কেন মামলা নেয়নি ওসি? ছিনতাইয়ের কি জিডি হয়?

ফেনীতে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে জায়গা দখল করেছে এক কাউন্সিলর, অন্যখানে আর একজন প্রভাবশালী নেতা। তাকে জায়গা দখলে সুরক্ষা দিয়েছে স্বয়ং সদর থানার ওসি। আমি বাধা দিতে চেয়েছি, আমাকে থামানো হয়েছে। কে থামাতে চেয়েছে সেটা আর না-ই বললাম।

ফেনী শহরজুড়ে অনেকগুলো পতিতালয় আছে৷ যেখানে মানুষকে নিয়ে ভিক্টিম বানিয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। এবং তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে টাকা উদ্ধার করা হয়। এরকম ঘটনা আমার কাছে এসেছে অসংখ্য। এসব পতিতালয়ের নিয়ন্ত্রক কারা?প্রকাশ্যে জনিকে অস্ত্রসহ ধরার পর পুলিশকে আসতে বলি স্পটে। সেখানে পুলিশ আসে এবং আমাকে সাহায্য করে। আমি পুলিশকে অস্ত্র আইনে মামলা করতে বলি, পুলিশ মামলা করতে অপারগতা জানায়। কেন? আমাকে পুলিশ এও বলে যে আমি ধরেছি আমাকেই মামলা করতে হবে। অথচ পুলিশ আমার সাথেই ছিলো। হাস্যকর না!ফেনীর এক চেয়ারম্যান আমাকে চোরাচালানের তথ্য দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক বড় নেতা থেকে শুরু করে সিন্ডিকেটের সবাই তাকে শাসিয়েছে। ডিবির এএসপি আমিনুল তাকে বলেছে সে কীভাবে নির্বাচন করে সেটা সে দেখে নিবে।

Advertisement

ফেনীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি জমির মাটি কাটা নিয়ে শুরু করে, মাদক, স্বর্ণ চোরাচালান প্রায় প্রতিটি বিষয়ে যতটা না অপরাধীদের সাথে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এই সিন্ডিকেটের সাথে।

ফেনীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রকদের শাস্তি প্রদানে কাজ করতে পারিনি আমি। একটা বছর ধরে পুরো সিন্ডিকেট মিলে আমাকে পদে পদে বাধা প্রদান করেছে। নির্বাচনে আমার গাড়ি থেকে প্রটেকশন উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। সারারাত জেগে আমার পরিবারকে পাহারা দিতে হয়েছে।

এই শহরের প্রতিটি ইঞ্চি আমি চিনি। শহরের প্রতিটি ইটের ভাষাও আমি জানি। সংগ্রামটা অবিশ্বাস্য হলেও শুধু আমার একারই ছিলো, আমি ভয়ানক একাই ছিলাম। শুধু আমার দুএকজন বস আর ফেনীর সাধারণ মানুষ ছিলো সাথে। তাদের কারণেই এক ইঞ্চি মাঠও ছাড়ি নাই।

তবে অনেক সময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি না, থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য নিজেকে প্রায়ই অপরাধী মনে হয়। পুরো প্রশাসন হয় উদাসীন, নয় অপরাধের সাথে জড়িত, সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত, অন্যায়ের সাথে, দুর্নীতির সাথে জড়িত। ঔদাসীন্যও এক ধরণের অপরাধ।

Advertisement

এদের মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনলে আমার থুতু দিতে ইচ্ছে হত। এগুলো কিছুই সাংবাদিকরা লেখেনি। আমি লিখতে বলেছি, এরা ভয়ে লেখে নাই। রয়েছে এমন শত শত ঘটনা। এসব ঘটনা বলার কারণ, এগুলো অন্যায়, ভয়াবহ অন্যায়। এই সমাজ এই অন্যায়গুলোর ধারক ও বাহক। এদের কাছে আপনি কীভাবে নুসরাত হত্যার বিচার পাবেন?

স্বেচ্ছায় বিদেশে এসেছি পড়তে, দেশে ফিরব পড়াশোনা করে। সরকার চাইলে কাজ করব, নাহলে চাকরি ছেড়ে দিব। প্রত্যয় এটুকুই- যুদ্ধের জীবন চলছে, চলবে।

ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানার বর্ণনার পর ফেনীর অবস্থা জানতে-বুঝতে আর কিছু লাগে না। ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেনের আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শাহাদত হোসেন শামীম বলেছে, .“নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর শামীম দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। বাইরে গিয়ে সে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোনে বিষয়টি জানায়। রুহুল আমিন বলে, আমি জানি। তোমরা চলে যাও’।

শামীমের জবানবন্দির তথ্যানুসারে সোনাগাজীর আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন নূসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তা হলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে না কেন?

এই রুহুল আমিনকে সঙ্গে নিয়েই সাংসদ নিজাম হাজারী নুসরাতদের বাড়িতে গিয়েছিলো। নিজাম হাজারী তাকে কেন সঙ্গে নিয়েছিলো? নিজাম হাজারীও কি তা হলে ঘটনা জানতেন? না কি কোনো কিছু না জেনেই রুহুল আমিনকে সঙ্গে নিয়ে নুসরাতদের বাড়িদের গিয়েছিলেন? তিনি নুসরাতের কবর জিয়ারত করেছেন। কন্যাহারা বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছেন। নুসরাতের কবরকে সাক্ষী রেখে নানান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নুসরাতের নামে ভবন এবং রাস্তার নামকরণ, মামলার যাবতীয় খরচ বহন ইত্যাদি ওয়াদা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নুসরাতের বাবাকে নিজাম হাজারীর জড়িয়ে ধরার ছবি এসেছে। অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ফুলেল ছবিও এসেছে।

সাংবাদিকদের সামনে পিবিআই’র ব্রিফিংয়ে আসামী সবার নাম ও চেহারা একটা টিভি স্ক্রীনে ভেসে উঠছিল। কিন্তু কয়েকজনের নাম ব্রিফিংকারী কর্মকর্তা চেপে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন যে কয়েকটি নাম তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই বলছেন না, যেন উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়। তা’হলে কী দাঁড়ালো অর্থটা।

এদিকে, ঐক্যের নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে সাতখুনসহ নানা ঘটনার সাক্ষী নারায়ণগঞ্জে। এ ঐক্যের প্রতীক পুলিশ। কোনো রাজনীতিক বা জনপ্রতিনিধি নন- সেখানকার এসপি হারুন এ আকর্ষণের মধ্যমনি। এর আগে, ঢাকা - গাজীপুরে থাকার সময়ও তিনি ছিলেন কেন্দ্রবিন্দুতেই। নারায়ণগঞ্জে তার বাংলোয় এমপি শামীম ওসমানের গমন, তাকে স্বাগত জানানো এবং এক টেবিলে মধ্যাহ্নভোজের খবর গণমাধ্যমে বেশ চমক তৈরি করেছে।

ভেন্যু, মেন্যু চমৎকার। তারিখটি আরো চমৎকার। পয়লা বৈশাখ। গত কিছুদিন পাল্টাপাল্টি হুমকি আর হুঁশিয়ারিতে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে এসপি হারুনের উদ্যোগে আয়োজিত পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে শামিল হন এমপি শামীম ওসমান। এর আগে, ৬ এপ্রিল নগরের ইসদাইরে অবস্থিত বাংলা ভবন কমিউনিটি সেন্টারে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে নেতা-কর্মীদের নিয়ে জরুরি কর্মিসভায় শামীম ওসমান আল্টিমেটাম দেন এসপিকে। বলেন, ‘শাহ নিজামের (নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক) বিরুদ্ধে জিডি করবেন। টিটুর (শামীম ওসমানের শ্যালক) বিরুদ্ধে মদ সাপ্লাইয়ের মামলা দিয়েছেন বলে আমি ভয় পেয়ে গেছি? মানুষ পোশাকধারী সন্ত্রাসীকে দেখতে চায় না। মশা মারতে কামান দাগাতে চাই না। আগামী ১০/১২ দিনেই টের পাইবেন।’

ওই দিনই এসপি হারুন পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ারি দেন, ‘মাদক, সন্ত্রাস ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। অপরাধী যত বড় আর শক্তিশালী হোক রক্ষা নেই। দুজনের এমন কথার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাদের এ পান্তা, বিভিন্ন ধরনের মাছ, ভর্তা, ফল, চটপটি ভোজ। বিএনপি-জাতীয় পার্টির কিছু নেতাও এ দাওয়াতি গণতন্ত্রে মেহমান হন।

নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পর থেকেই এসপির কিছু কাজে বিরক্ত এমপি। গত ২৬ ডিসেম্বর পুলিশের ব্যবহৃত ওয়্যারলেস সেট দিয়ে গোপন নির্দেশনা ও তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে শামীম ওসমানের দেহরক্ষী কনস্টেবল মামুন ফকিরের কাছ থেকে ওয়্যারলেস সেট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। চলতি বছরের মার্চে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এমপির ছেলে অয়ন ওসমানের সঙ্গে কক্সবাজারে থাকার দায়ে দেহরক্ষী মামুন ফকিরকে কিশোরগঞ্জে বদলি করা হয়।

এরপর শামীম ওসমানকে দেহরক্ষী দেওয়া হলেও তিনি তা নেননি। স্থানীয় কারো কারো মতে, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে ওসমান পরিবারের ভুল বোঝাবুঝির আপাতত নাটকীয় অবসান হয়েছে। এসপি দাওয়াত দিয়ে এমপির মান ভাঙালেন। আর এমপি দাওয়াতে এসে এসপির মান বাঁচালেন। প্রশ্নের কিন্তু ফয়সালা হলো না। এই গণতন্ত্রের জের কী? এমপির বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসপির পাঠানো অভিযোগনামারই বা কী হবে?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম