বঙ্গবীর শমসের গাজী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনার কৃষক বিদ্রোহের নায়ক। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ‘ভাটির বাঘ’ বলে পরিচিত। শমসের গাজী নবাব সিরাজ উদ দৌলার পর ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম নিহত হন। ইতিহাসের আড়ালে থাকা ভাটির এ বাঘকে নিয়ে লিখেছেন মঞ্জুর মোর্শেদ রুমন-
Advertisement
বাংলার ইতিহাসে যে কয়জন ক্ষণজন্মা পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে শমসের গাজী অন্যতম। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বণিক ও দেশীয় দোসরদের বিশ্বাসঘাতকতা আর ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য যখন অস্তমিত হয়, ঠিক তখনই বাংলার পূর্ব দিগন্তে এই শমসের গাজীর অভ্যুদয় ঘটেছিল। তবে তার বীরত্বপূর্ণ অবদান নিয়ে ইতিহাসবিদগণ খুব একটি নির্মোহ আলোচনা করেছিলেন বলে মনে হয় না।
গাজীর জন্ম ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিজকুঞ্জরা গ্রামে ১৭০৫ মতান্তরে ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে। অল্প বয়সে পিতৃহারা হন শমসের গাজী। অভাবের সংসার থাকা সত্ত্বেও তিনি ছোটবেলায় দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন। একদিন মায়ের বকুনি খেয়ে ফেনী নদীর তীরে বসে কাঁদছিলেন। তখন শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেন শমসেরকে দেখতে পান। দয়াপরবশ হয়ে তিনি শমসেরকে শুভপুর নিয়ে যান।
> আরও পড়ুন- মৃত্যুঞ্জয়ী নারীর নাম রমা চৌধুরী
Advertisement
শুভপুরের তালুকদারের কোন সন্তান ছিল না। সেখানে স্নেহ-মমতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন শমসের গাজী। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুস্তি, লাঠিখেলা, তীর-ধনুক চালনায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে শিকারে গিয়ে একটি হিংস্র বাঘকে হত্যা না করে জীবিত বন্দি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর যুবক শমসের গাজী শুভপুরের খাজনা আদায় শুরু করেন। শুরু হয় তার উত্থান। তখন ‘বাংলার বীর’ বা ‘ভাটির বাঘ’ হয় তার উপাধি। সে সময় তিনি চোর, ডাকাত ও জলদস্যুদের রুখতে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। শমসের গাজী ছিলেন প্রজাদরদি। পাহাড়িয়া ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে তিনি কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন। পরবর্তী তিন বছর মহারাজের রাজকোষে খাজনা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এতে ত্রিপুরা মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৭ হাজার সৈন্য পাঠায় গাজীকে উচ্ছেদ করার জন্য। ফল হয় বিপরীত। শোচনীয় পরাজয়ে প্রাসাদ ছেড়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।
ত্রিপুরা রাজ্যের বিরাট অংশ শমসের গাজীর করতলে এসে যায়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, কসবা, কুমিল্লার চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, সমগ্র ভুলুয়া (বর্তমান নোয়াখালী), সমগ্র ফেনী, নিজামপুর পরগনা থেকে ইসলামাবাদ (চট্টগ্রাম) পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল ত্রিপুরার উদয়পুর। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজাবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুরারাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। তার কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা।
> আরও পড়ুন- সবার কাছে তিনি মানবতার ফেরিওয়ালা
Advertisement
ইতোমধ্যে প্রজা সাধারণের কল্যাণে স্ত্রীর নামে রাস্তা নির্মাণ, বাজার বসানো, মায়ের নামে দীঘি খনন, মগ এবং জলদস্যুতার হাত থেকে রক্ষা করে গাজী তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তবে এতে বাধ সাধে ইংরেজরা। তারা তার জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পড়ে। ভাবেন, যেভাবে তার জনপ্রিয়তা আর সৈন্য বাড়ছে, একসময় তা ইংরেজদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ফলে ইংরেজরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ঘেরাও করে গাজীর আস্তানা। বন্দী করে তাকে। তারপর মুর্শিদাবাদে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এ বীরকে।
এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে পতন হয় আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের। বাংলা হারায় আরেক নবাবকে। সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি এ নির্মম হত্যাকাণ্ডকে। এখনো স্থানীয়রা তার স্মৃতি রক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেন। যদিও নবাব শমসের গাজীর বংশধর পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঞাঁ স্মৃতি ধরে রাখতে শমসের গাজীর বাঁশেরকেল্লা রিসোর্টটি তৈরি করেছেন।
এসইউ/জেআইএম