‘উন্নয়নের প্রসববেদনা’ বলে একটা শব্দ আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বড় কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হওয়ার সময় নাগরিককে কিছু যন্ত্রণাও ভোগ করতে হয়। কিন্তু রাজধানীবাসী এ মুহূর্তে যা ভোগ করছেন সেটি আসলে উন্নয়নের প্রসববেদনা নাকি অপরিকল্পিত উন্নয়নযজ্ঞ—তা নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে। প্রায় প্রতিদিনই নাগরিকরা উন্নয়নভোগান্তির নানাবিধ চিত্র তুলে ধরছেন।
Advertisement
একজন সিনিয়র সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন: ‘উন্নয়ন কাজের জন্য যে যানজট যন্ত্রণা ভোগ করছি তা আর নেয়া যাচ্ছে না....পরিবাগ থেকে বাংলা মোটর পর্যন্ত এলাম ৫০ মিনিটে...আমার মনে হচ্ছে উন্নয়ন কাজ শেষ হবার পর অফিস আদালত খুলুক...সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হোক...এলিভটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ যাবতীয় কাজ হলে সবাই কাজে যোগ দিক।’
এই বক্তব্যের মধ্যে যে খেদ ও যন্ত্রণা আছে, তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তারাও যে এই দুর্ভোগের শিকার হন না, তাও না। কারণ মেট্রোরেলের কাজের জন্য এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কই অর্ধেক হয়ে গেছে। ফলে পথে চলতে গিয়ে নীতি-নির্ধারকরাও বিড়ম্বনায় পড়ছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এরকম একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নাগরিক ভোগান্তি যাতে এড়ানো যায়, সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন?
১৩ মার্চ খোদ হাইকোর্টও একটি রিট আবেদনের শুনানিতে রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ যেসব এলাকায় চলছে, সেসব এলাকায় প্রচুর ধুলাবালি পরিবেশকে দূষিত করছে। আমাদের মেট্রোরেল প্রয়োজন। কিন্তু একই সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধও জরুরি। আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হলে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে।’এর আগে ২৮ জানুয়ারি রাজধানীতে বায়ুদূষন বন্ধে জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ধুলাবালি প্রবণ এলাকাগুলোতে দিনে দুবার পানি ছিটাতে দুই সিটির মেয়র ও নির্বাহীদের নির্দেশ দেন।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের ‘বিশ্ব বাতাসের মান প্রতিবেদন ২০১৮’অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বায়ুদূষণের কবলে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান ১৭তম। আর রাজধানী শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এই শহরের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তু কণিকার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫) পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম বেঁধে দিয়েছে। অথচ রাজধানীর বাতাসে এই কণিকার মাত্রা ২০১৮ সালে ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম।
২০১৭ সালে এই মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। বলা হচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলসহ নানারকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে এই দূষণ আরও বেড়েছে। কিন্তু এসব বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে বায়ু দূষণ ও নাগরিকের ভোগান্তির বিষয়টি যে নীতিনির্ধারক বা দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্টদের বিবেচনায় ছিল না বা থাকলেও যে সেটি কোনো ফল দেয়নি, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নাগরিকরা।
বিভিন্ন সড়ক অর্ধেক হয়ে যাওয়ায় সেসব সড়ক এড়িয়ে চলে পাবলিক বাসগুলো। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে একদিনে যেমন মানুষের সময় বেশি লাগছে, তেমনি বিভিন্ন এলাকায় অফিসে যাওয়া-আসার সময় যানবাহনের তীব্র সংকট দেখা দেয়। আমাদের এক সহকর্মী সম্প্রতি তার নিজের একটি অভিজ্ঞতা বললেন এরকম: মিরপুর থেকে যে বাসে উঠেছিলেন, সেটি আড়ংয়ের উল্টো দিক দিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে টার্ন নিতে গেলে পুলিশ সেটি ঘুরিয়ে দেয়। এ সময় তিনি পুলিশকে জিজ্ঞেস করেন, এখন ফার্মগেটে যারা যাবেন, তারা কী করবেন? জবাবে ওই পুলিশ সদস্য তাকে রসিকতা করে বলেন, ‘মেট্রোরেলের কাজ হইলে যাইয়েন।’
অর্থাৎ উন্নয়ন করতে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এটি এখন রসিকতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এ মুহূর্তে রাজধানীর যেসব লোককে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে না হয় বা পাবলিক পরিবহনে উঠতে হয় না, তারা নিতান্তই সৌভাগ্যবান। মিরপুর এলাকায় যার বাসা এবং তার অফিস যদি হয় কারওয়ানবাজার বা মতিঝিলে, তাহলে এখন তাকে এই যাওয়া-আসা মিলিয়ে কয়েক ঘণ্টা শুধু রাস্তায় বসে থাকতে হয়, বিষয়ট তা নয়, বরং তার উপর দিয়ে যে শারীরিক ও মানসিক চাপ যায়, সেটিরও অর্থনৈতিক মূল্যও অনেক।
Advertisement
তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। তিনি শারীরিক ও মানকিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে তিনি আর স্বাভাবিক মানুষ থাকছেন না। এরকম অনেককেই চিনি, যারা শুধু এই পথের যন্ত্রণার কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে শুধু ঢাকা শহরেই দৈনিক গড়ে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটের কারণে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে গড়ে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
তাছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটে মানুষের মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা অনেক গুরুতর রোগের কারণ। সবার পক্ষে অফিসের কাছে বাসা কিংবা বাসার কাছে অফিস নেয়ার সামর্থ্যও থাকে না। স্মরণ করা যেতে পারে, হলিউড তারকা ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে গেলেন, তখন ফেসবুকে অনেকেই জোলি ও মিরপুর এলাকায় নাগরিক দুর্ভোগের কিছু ছবির কোলাজ দিয়ে লিখেছিলেন, কক্সবাজার পরিদর্শন শেষে জোলি যেন মিরপুরবাসীকে দেখে যান। এখানে যতটা না রসিকতা তার চেয়ে অনেক বেশি আছে নাগরিকের ক্ষোভ।
১৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমের শিরোনাম ‘যানজটের শহর হিসেবে বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ঢাকা’। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ বলা হয়েছে, ২০১৮ এবং ২০১৭ সালে যানজটে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ২০১৬ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয় এবং ২০১৫ সালে ছিল অষ্টম। তার মানে প্রতি বছরই এই মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেছেন, ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় খুব শিগগিরই দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে। তার কাছে কী জাদু আছে, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
যানজট নিরসনে ২০১৬ সালের ২৬ জুন মেট্রো রেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। মেট্রো রেলের ২০.১ কিমি লাইন দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে। যাতে সময় লাগবে মাত্র ৩৭ মিনিট। যানজটে নাকাল নগরবাসীর জন্য তাই এটি দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। কিন্তু এই প্রত্যাশা পূরণের মাশুল যেভাবে নাগরিকরা দিচ্ছে, সেটি চাইলেই কি নিরসন করা যেত না?
আবার রাজধানীর বুকে চলমান উন্নয়ন কাজগুলো ঠিক কবে শেষ কবে, তাও পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ নাগরিকদের এই দুর্ভোগ কতদিন ভোগ করতে হবে কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং মেট্রোরেল হলেই যে এই শহরের চিত্র আমূল বদলে যাবে, সেটিও কি খুব নিশ্চিত করে বলা সম্ভব? প্রতিটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে। মেয়াদ বাড়া মানে খরচ বাড়ে। বলাই হয়, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে বাংলাদেশের মতো এত বেশি অর্থ খরচ উন্নত বিশ্বেও হয় না।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের রাস্তা-সেতু ও ভবনের মান কি উন্নত বিশ্বের চেয়েও ভালো? যদি না হয় তাহলে এই যে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ হচ্ছে, তার কত ভাগ কাজ হচ্ছে আর কত ভাগ লুটপাট হচ্ছে, নাগরিকদের মনে সেই প্রশ্নও আছে। তাছাড়া সারা পৃথিবীতেই রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়। কিন্তু সেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এরকম ব্যাহত হয় কি না সন্দেহ। ফলে উন্নয়নের প্রসববেদনার সাথে সাথে নাগরিকদের এই বেদনাগুলোও আহত করে।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। ৯ এপ্রিল সকালে অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। তার কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলে রাজধানীতে যে সি বিচের আবহ তৈরি হয়, তা নতুন কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ছাড়িয়ে হাতের বাঁয়ের দেয়ালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বেশকিছু সাইনবোর্ড যেখানে লেখা, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়—যেখানে আপনার একটি স্বপ্ন আছে’।
ভাবছিলাম এখানে আমার কী স্বপ্ন আছে কিংবা আদৌ কিছু কি আছে? ভাবতে ভাবতে সামনে দেখা গেলো মেট্রো রেলের কাজের জন্য রাস্তা যেহেতু এখন অর্ধেক এবং তারউপর বৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং গাড়ির যে জটলা তাতে ডাক্তারের নির্দেশমতো ১২ টার মধ্যে পৌঁছানো অসম্ভব। অটোরিকশা চালক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পেছনের রাস্তায় ঢুকে পড়লেন। র্যাব-২ কার্যালয়ের পাশের রাস্তা ততক্ষণে জলে থই থই। কিন্তু বোঝার উপায় নেই পানিতে চাকা তলিয়ে যাবে কি না। যেহেতু আর কোনো বিকল্পও নেই, চালক সাহস করে রওনা দিলেন এবং কিছুদূর গিয়েই বড় গর্তে পড়ে স্টার্ট বন্ধ। এরপর আরও দুটি অটোরিকশা এবং প্রাইভেট কারের একই পরিণতি। চালক অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও অটোরিকশাকে গর্ত থেকে তুলতে ব্যর্থ। শাশুড়িকে অটোরিকশায় বসিয়ে রেখে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট ভাঁজ করে নোংরা পানির ভেতরে নেমে বেশ খানিকক্ষণের চেষ্টায় সিএনজি অটোরিকশাকে রাস্তায় তোলা সম্ভব হয়।
এরপর মেইন রাস্তায় ওঠা পর্যন্ত আরও একাধিকবার এই পরিস্থিতি হতে হতে আমরা বেঁচে যাই। খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পেছনের এই বিভীষিকাময় সড়কের খবর মাননীয় মন্ত্রী রাখেন কি না জানি না। তবে জীবনে প্রথম হাঁটুসমান নোংরা পানিতে নেমে অটোরিকশা ঠেলার সময় দুটি প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো—১. এই কাজটি আমি কোথায় বসে করছি, রাজধানীতে নাকি আষাঢ় মাসে কোনো অজপাড়াগাঁয়ে এবং ২. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আমার কী স্বপ্ন আছে?...
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমকেএইচ