মতামত

অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীনতার বিপরীতে বিভ্রান্তি ও বিভাজনের বিষ

দেশব্যাপী উদযাপিত হলো পহেলা বৈশাখ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশগ্রহণে এই যে নববর্ষ উদযাপন বাঙালি হিসেবে সকলকে আশাবাদী করে তোলার কথা থাকলেও কোথায় যেনো একটা ‘কিন্তু’ থেকে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখকে একটি জাতীয় ও সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। কিন্তু তার বিপরীতে এই পহেলা বৈশাখ পালনকে একটি পক্ষ ‘অনৈসলামিক’ এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটি উৎসব হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে সে সম্পর্কে আলোচনা হওয়াটা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। জরুরি এ কারণে যে, বিভক্ত বাঙালি ক্রমাগত নতুন বিভক্তি নিয়ে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে সে উন্নয়ন কোনো ভাবেই টেকসই হবে না বরং যে কোনো সময় রাষ্ট্র ব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়।

Advertisement

পহেলা বৈশাখ পালনের উৎপত্তি এবং বাঙালি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পরম্পরা বা ইতিহাস নিয়ে এখানে আলোচনার কিছু নেই। তবে আলোচনার সুবিধার্থে এই স্মৃতিচারণ খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, একেবারেই শিশুকালে দেশের যে অঞ্চলে বেড়ে ওঠার সময়টা কেটেছে সেখানে বৈশাখী মেলা একাধিক জায়গায় আয়োজিত হতো। সেখানে সকল ধর্মের শিশু-কিশোর বা যুবকের উপস্থিতি থাকলেও নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে ‘যুবতী’ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মেলায় ‘হিন্দুদের’ বলে মুসলমান পরিবারের শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি কম থাকতো কিংবা উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেতে অভিভাবককে বিশেষ ‘তেল’ দিয়ে তবেই অনুমতি পাওয়া যেতো।

এর সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির অজুহাতও থাকতো বটে। কিন্তু যে বার আব্দুল আলি নামক এক মুসলিম যুবকের এরকম একটি মেলায় গুড়ের জিলাপি কিনে খাওয়ার পর কলেরা দেখা দিলো এবং সকলের চোখের সামনে সে মারা গেলো, তার পরের বছরেই কিন্তু এই খবর রটে গেলো যে, হিন্দুদের এই মেলায় গেলে মুসলমানের কলেরা হয়, সুতরাং সেবার এই মেলায় উপস্থিতির সংখ্যা ব্যাপক ভাবে কমে গিয়েছিল।

দীর্ঘকাল দেশছাড়া ফলে এসব মেলায় কী হয়, কেমন মানুষ হয় সে খোঁজ জানা ছিল না। কিন্তু এবার যখন খোঁজ নেওয়া হলো তখন যে তথ্য পাওয়া গেলো তাতে পরিস্থিতিটা উদ্বেগের চেয়েও ভয়েরই বটে। এলাকা বহু আগেই প্রায় হিন্দু-শূন্য হয়ে গেছে। ফলে ঘটা করে একাধিক জায়গায় এরকম মেলা বা ‘আড়ং’ মেলানোর লোকের অভাব দেখা দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো যেসব জায়গায় এসব মেলা হতো সেসব জায়গা দখল হয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন বাড়ি-ঘর উঠেছে বা ধানি জমি হয়ে গেছে।

Advertisement

তবুও অবশিষ্ট চিলতেখানেক জায়গায় যে আয়োজন বসে তা নামকাওয়াস্তে এবং সেখানে উপস্থিতির সংখ্যা যেমন কম তেমনই সাবেক সেই মেলা-কেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কেনাকাটি (যেমন এসব মেলা থেকেই ডালা-কুলা-সের-পলো’র মতো প্রয়োজনীয় নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র)-র কোনো প্রয়োজনীয়তাও গেছে কমে কারণ তার জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, এই মেলায় যাওয়া বা না-যাওয়া নিয়ে বিভক্তিটাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ও সহিংস হয়েছে।

যে কারণে গ্রামের আশেপাশে অন্ততঃ যে চার/পাঁচটি মেলা বসার কথা শৈশবে জানতাম তার প্রায় সত্তরভাগ ক্ষেত্রে মেলা বন্ধ হয়ে গেছে আর বাকি ত্রিশ ভাগ ক্ষেত্রে এসব মেলার চরিত্র বদল হয়েছে। এই চরিত্র বদল নিয়ে পরে কোনো লেখায় কথা বলা যাবে কারণ রাষ্ট্রের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি-নির্ভর এসব মেলা বা উদযাপনের চেহারাও বদলাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্নটা ভিন্ন জায়গায়, সেটা হচ্ছে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে শহুরে মধ্যবিত্ত বিবেকও যে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তারা সেই প্রশ্নকে ধর্মের দ্বারা যৌক্তির করে তুলতে চাইছেন এবং একথা বলতেও তারা দ্বিধা করছেন না যে, এই সরকার বদলে গেলেই তারা ‘নতুন করে পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন করবেন। প্রশ্ন হলো, পহেলা বৈশাখও কী করে একেক পক্ষের কাছে একেকরকম? আর এক্ষেত্রে আওয়ামী-বিএনপি’র চিরাচরিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে পহেলা বৈশাখও কী ভাবে ভিন্ন, তার স্বরূপটি উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে পুনর্বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পহেলা বৈশাখকে সর্বজনীনভাবে পহেলা বৈশাখকে বাঙালির একমাত্র ‘অসাম্প্রদায়িক’ উৎসব হিসেবে পালনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এমনকি এর মাত্রা বদলাতে পহেলা বৈশাখে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘মহার্ঘ ভাতা’ চালুরও ঘোষণা দিয়েছে এবং কার্যকরও করেছে। দেশের শিক্ষায়তনগুলিতে এই উৎসবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মূল কারণ এটাই যে, ঈদ বা পূজার মতো ধর্মভিত্তিক উৎসবের বাইরে পহেলা বৈশাখই হতে পারে একমাত্র উপলক্ষ যেখানে সকল ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে উদযাপনে সামিল হতে পারে।

প্রত্যেকটি উৎসবেরই নিজস্ব ভাষা থাকে, সঙ্গীত থাকে, পোশাক থাকে, উদযাপনের ভঙ্গী থাকে। আগেই বলেছি যে, গ্রামের সঙ্গে শহরের বৈশাখ উদযাপনে আশি-নব্বইয়ের দশকেও বিস্তর ফারাক ছিল। রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখকে বরণ করার ছায়ানট-এর উদ্যোগ ও তার পেছনের ইতিহাস আমরা জানি।

Advertisement

এমনকি চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রারও শুরু হওয়া থেকে আজকের অবস্থানে আসার গল্পটা আমাদের জানা। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সারা দেশে এই রমনা ও চারুকলার উদ্যোগকে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণটা স্পষ্ট এ কারণে যে, আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিল এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে এদের উদযাপনের ধরনটা মেলে।

আবার উল্টোদিকে ভাবলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি ও রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গেই ছায়ানট বা চারুকলার এই বৈশাখ উদযাপনের ধরনটা সাংঘর্ষিক। তারা ক্ষমতায় এসে এই উদযাপনকে বন্ধ না করলেও কোনো ভাবেই তারা এই উদযাপনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি বরং রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনার সঙ্গে আমরা মিলিয়ে ফেলতে পারি সারা দেশে একযোগে পাঁচশ’রও বেশি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাকে।

যে বিরোধ ও মনস্তত্ব থেকে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ঘরানা তৈরি হয়েছে তার সমর্থক এদেশে কম যে নয় সেকথা কেউ না মানতে চাইলে তাকে বোকার হদ্দই বলতে হবে। কিন্তু এটাও সত্য যে, ১৯৪৮ থেকেই আওয়ামী লীগও এই বিপরীত সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এদেশে রাজনীতি করেছে এবং ১৯৭১ সালে তারা সফলতা অর্জন করেছে, ৭৫-এ আবার হেরেছে, ২০০৮ সালে এসে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার বিপরীতে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরিতে সফল হয়েছে।

সফলতার মাত্রা এবং ধরন নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি কারণ, আওয়ামী লীগও বাঙালি মুসলমানের মন বুঝে ভোটের রাজনীতিতে অনেক ছাড় দিয়েছে এবং ক্রমাগত দিয়েই চলছে। এর ভেতরেও পহেলা বৈশাখের মতো একটি উপলক্ষকে বেছে নিয়ে এই দিনটিকে বাঙালির ‘অসাম্প্রদায়িক’ উদযাপনের সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টাকে প্রশংসা না করে উপায় কি?

বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের বিপরীত রাজনীতি যখন বাঙালিকে এরকম একটি সর্বজনীন উদযাপন দিতেতো পারছেই না, বরং এটাকে ঠেকানোর জন্যও উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের কাছে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিকে মনে হয় সরকারের “লবিং”-এর ফল, যদিও প্রায় শ’তিনেক বছরের পুরোনো কলকাতার শারদীয় দুর্গোৎসব মাত্র এ বছরই ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।

এখন আওয়ামী লীগের বহু পদক্ষেপের যৌক্তির সমালোচনার মতো আমরা এটা নিয়েও সমালোচনা করতে পারি যে, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হলো কিনা? কিংবা এই যে নিরাপত্তার অজুহাতে মেলাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়াটা কতোটা কার্যকর হলো? কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এর বিকল্প হিসেবে কী করলে বাঙালিকে একটি সর্বজনীন উৎসব উদযাপনে একত্রিত করা যেতো এবং তাতে কোনো পক্ষেরই ধর্মানুভূতি আহত হতো না সেটাও খুঁজে বের করা প্রয়োজন নয় কি?

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যারা মনে করছেন দেশব্যাপী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বর্তমান প্রক্রিয়াটি সঠিক নয় এবং এটি আওয়ামী-রাজনীতির অংশ তারা কিন্তু এখনও ঝেড়ে কাশছেন না আসলে তারা কী ভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে চান? বা আদৌ পহেলা বৈশাখের উদযাপনকে তারা মানেন কি না? একদলতো দেখলাম পহেলা বৈশাখ উদযাপনে মিলাদ মাহফিল-এর আয়োজন করতে চাইছেন বা করছেন। কিন্তু তাহলে অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের উদযাপনের কী হবে? এভাবে আলাদা আলাদা ঘরে-ঘরে ‘নিজস্ব কায়দায়’ পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলেতো এর মূল যে ‘স্পিরিট’ বা মাহাত্ম্য/উদ্দেশ্য সেটাইতো ব্যাহত হবে, তাই না?

বাঙালিকে বর্ণ-ধর্ম-বিশ্বাস নির্বিশেষে একটি উৎসবে সামিল করার যে অন্তর্নিহিত ভাবনা তাকেইতো অস্বীকার করা হবে এরকমটি হলে। কিন্তু এটাতো লক্ষ্যমান যে, গত দশ বছরে পহেলা বৈশাখ সত্যিকার অর্থেই “অসাম্প্রদায়িক” চরিত্র নিয়ে একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবেই উদযাপিত হচ্ছে, তাহলে এইসব বক্র ও ব্যঙ্গ প্রশ্ন দিয়ে একে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া কেন?

শেষ পর্যন্ত যদি রাজনীতিই কোনো উদ্দেশ্যের পথনির্দেশক হয় তাহলে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই, এর কার্যকর কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলা গেলেও যেতে পারে তবে এর বিপরীত রাজনীতির হাতে যে বিভ্রান্তি ও বিষাক্ত বিভক্তি তৈরির চেষ্টা দৃশ্যমান তা আসলে ভয়ংকর। বাঙালি সাংস্কৃতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি এই সব কোনো মুক্তি-তেই এই ‘বিভ্রান্তি ও বিভাজনের’ জায়গা খালি নেই, কিন্তু এই মুক্তি-কে আরও কী ভাবে ঋদ্ধ করা যায়, এখন সেটাই ভাববার সময়। ঢাকা ১৫ এপ্রিল, সোমবার ২০১৯

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/এমকেএইচ