ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। লিখছেন, গবেষণা করছেন অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি, উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।
Advertisement
আলোচনায় গুরুত্ব পায় অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতি-গণতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়টিও। ‘বাজেটকে অর্থ অপচয়ের বিশেষ আয়োজন’ বলে উল্লেখ করেন এ বিশেষজ্ঞ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
আরও পড়ুন >> কথিত উন্নয়নে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ছে
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের অর্থনীতির বিশ্লেষণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রশ্নে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- উভয় সূচকই সামনে আসছে। আসলে বাংলাদেশ এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
Advertisement
সালেহউদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশ এখন দুটি মাইলস্টোন অতিক্রম করে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। বিশ্বব্যাংকই এ তকমা দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই ভালো কিছু বার্তা বহন করে। আমি মনে করি, এ দুটি সূচকে অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ অবশ্যই বৈশ্বিক প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রার জন্য ৪৮ বছর লেগেছে। এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘ সময়। চ্যালেঞ্জগুলো আরও বড় হয়ে এসেছে আমাদের জন্য।
জাগো নিউজ : কোন কোন চ্যালেঞ্জের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া যায়?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়া। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, উন্নয়নশীল দেশের তালিকার নিম্ন স্থান থেকে উন্নয়ন ঘটানো।
Advertisement
সামষ্টিক সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে এবং আমরা তা-ই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি কমছে, বিনিয়োগ বেড়েছে, রপ্তানি আয় বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, ফরেন রিজার্ভ বেড়েছে এবং এগুলো সামষ্টিক সূচক মাত্র।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব উন্নয়নের ফলাফল কারা ভোগ করছেন? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ঠিক, কিন্তু দিন দিন মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েই যাচ্ছে। নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষ উন্নয়নের সুবিধা থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থাৎ আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ বৈষম্যের কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি গড়পড়তায়। সবার আয় বাড়েনি।
আরও পড়ুন >> উন্নয়নের সঙ্গে অপচয়ও হচ্ছে
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন ঘটেছে, তাও বলা যাবে না। জাগো নিউজ : কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে আশার কথাও আছে। সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে…
সালেহউদ্দিন আহমেদ : স্বাস্থ্যসেবায় প্রাথমিক পর্যায়ের উন্নয়নের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। যেমন, মাতৃমৃত্যুর হার কমে এসেছে। শিশুমৃত্যুর হারও কমছে। এগুলো প্রাইমারি লেভেলের সেবা। এটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়। কিন্তু সেকেন্ডারি লেভেলের সেবাও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। একজন গরিব মানুষেরও কিডনি সমস্যা হচ্ছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যান্সার হচ্ছে। সে কোথায় যাবে? সরকারি হাসপাতালে সেবা নেয়ার কথা। তা তো হচ্ছে না। গরিব মানুষের জন্য সেকেন্ডারি লেভেলের চিকিৎসাসেবা সরকারি হাসপাতালগুলো কোনোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছে না। অথচ বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ঠিকই এসব রোগের আধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে। ওইসব হাসপাতালে কিন্তু গরিব মানুষের সেবা নেয়ার সামর্থ্য নেই।
শিক্ষার উন্নয়নের নানা কথা শোনানো হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, এটি এখন এক বাক্যেই স্বীকার করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়িয়ে কী লাভ, যদি মান না বাড়ে। বাংলাদেশে শিক্ষার মান এখন অত্যন্ত নিম্নমানের এবং দিন দিন এ মান আরও কমছে।
সাধারণ মানুষের আবাসন নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। কয়েকটি শহর ছাড়া সেই অর্থে আবাসন শিল্প গড়ে ওঠেনি। শহরের অধিকাংশ মানুষ ভাড়ায় থাকেন, তাদের কোনো নিজস্ব বাড়ি নেই। আবার শহরের বাসা-বাড়ি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আগুনে মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এমন সময়ে তো এ সূচকগুলো কোনোভাবেই সামনে আসার কথা নয়।
জাগো নিউজ : অগ্রগতির জন্য তো সময়ও দিতে হবে…
সালেহউদ্দিন আহমেদ : ৪৮ বছর অবশ্যই কম সময় নয়। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বাংলাদেশের কাতারেই ছিল। অথচ তারা তরতর করে এগিয়ে গেছে। আমরা সেই ধারায় এগোতে পারিনি এবং সেটি রাজনৈতিক দৈন্যের কারণেই।
আরও পড়ুন >> মন্ত্রীরা দেশে চিকিৎসা নিলে ভরসা পান সাধারণরা
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান সংকট নিয়ে কী বলবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ভয়াবহ মাত্রায় কমে এসেছে। এটিই বড় সংকট বলে মনে করছি। এ খাতের বিনিয়োগ কমে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে, অথচ কয়েক বছর আগেও ১৬ শতাংশে ছিল।
সরকার বড় বড় বিনিয়োগ দেখাতে গিয়ে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আড়াল করে ফেলছে। তারা ব্যাংক ঋণ পায় না বললেই চলে। ব্যাংকের সামান্য অর্থ তাদের কাছে যায়। বাকি সব বড় বড় পুঁজিপতিদের দখলে। এ কারণে বিনিয়োগ সঠিক পথে হয় না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে সব জায়গাতে স্থবিরতা নেমে আসে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান হয় না এবং এ কারণে সামাজিক অস্থিরতা তীব্র হয়।
জাগো নিউজ : তাহলে বাংলাদেশের এ উন্নয়ন আসলে কীসের চিত্র বহন করছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : উন্নয়ন কৌশলে গলদের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। সরকারি নীতিতে গলদ আছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে উন্নয়ন সুবিধা সবাই পাচ্ছে না।
বাংলাদেশে এখন যে উন্নয়নের স্লোগান চলছে, ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলেও তা ছিল। কিন্তু সে উন্নয়ন সবাইকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। আইয়ুব খানের উন্নয়ন ঘুরেফিরে ফের আসছে। সামগ্রিক বণ্টনের উন্নয়ন পাকিস্তান আমলে হয়নি, এখনও হচ্ছে না।
ফের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার কথা সামনে আসছে। মানুষ মানসম্মত শিক্ষা পেলে তার আর অন্যকিছুর দরকার পড়ে না। সে উঠে আসবেই। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে পরিশ্রমের ফলাফল আসবেই।
জাগো নিউজ : কী ধরনের কৌশলের ওপর আপনি গুরুত্ব দেবেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ : সরকার প্রতি বছর যে আর্থিক নীতি গ্রহণ করে, সেখানে দেখবেন বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা বেশি। উদাহরণ দিয়ে বলি। পোশাক খাত আমাদের এখন একমাত্র রপ্তানি খাত হয়ে উঠছে। গলদটা এখানেই। সব খাত বন্ধ করে দিয়ে সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্ত উৎসাহ, প্রণোদনা গার্মেন্টস খাতে দিচ্ছে। একটি শ্রেণির ব্যবসায়ীরা এখানে লাভবান হচ্ছে। কোনো কারণে এ খাতে ধস নামলে রপ্তানি শূন্যের কোটায় চলে আসবে। অথচ ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আপনি কোনো ব্যবস্থা রাখছেন না।
আরও পড়ুন >> উন্নয়নের আড়ালে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে
ব্যাংকগুলো পোশাক কারখানার মালিকদের কাছে কুক্ষিগত। মূলধন নির্ভর বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে। অধিক শ্রমনির্ভর শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে না। জাপানে দেখবেন, বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা দেয়া হয়। অথচ আমরা উৎপাদন ও সার্ভিস সেক্টরের উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত। জনবহুল দেশে উৎপাদনের সঙ্গে মানুষের শ্রমকে সংযুক্ত করতে না পারলে আয়ের বৈষম্য বাড়বেই। কারণ উৎপাদনের আয় তখন গুটিকয়েক মানুষের পকেটে যায়।
কর্মসংস্থান নিয়ে সরকারের কোনো কৌশল দেখতে পাবেন না। দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে তো নানা প্রশ্ন! এরপরও শিক্ষিত বেকারের হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রেডিং সেক্টর ও সার্ভিস সেক্টরে জোর দেয়ার কারণে এমন হচ্ছে। ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নামে কয়েকজন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, এতে সত্যিকার শিল্পের বিকাশ হয় না।
এএসএস/এমএআর/এমএস