জাতীয়

অনন্ত আকাশে মাথা তোলার বাসনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা

অনন্ত আকাশে মস্তক তোলার বাসনায় হলো ১৪২৬ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে।’ রোববার সকাল ৯টায় শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর শাহবাগের ঢাকা ক্লাবের সামনে দিয়ে ঘুরে টিএসটি মোড় হয়ে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে শেষ হয়।

Advertisement

শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ। বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালির নানা আয়োজনের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্যতম।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ৩০ বছর পূর্তি হলো এ বছর। এবারের শোভাযাত্রার স্লোগানটি কবিগুরুর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন শোভাযাত্রায়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।

Advertisement

শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে চালু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।

শোভাযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। নয়টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভা পায় নানান রঙ্গের ফুলের টায়রা। তরুণদের পরনে ছিল লাল-সাদা পাঞ্জাবি।

শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র‌্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন।

Advertisement

এবারের শোভাযাত্রার শিল্প-কাঠামোগুলোর একটিতে বাঘের মুখ থেকে কাঁটা তোলার চিরায়ত গল্পটি উপস্থাপিত হয়েছে বাঘ ও বকের অনুষঙ্গে। ছিল মঙ্গলের বারতা পেঁচা। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ছিল ছাগলের কাঠামো। এ ছাড়া ছিল দুই মাথা ঘোড়া, দুই পাখি ও কাঠঠোকরা। শোভাযাত্রায় আরও ছিল মা ও শিশু এবং বাঘের মুখোশ, টেপাপুতুল, রাজা-রানির মুখোশ, সূর্য ইত্যাদি।

পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে মানবপ্রাচীর গঠন করা হয়। গতবারের মতো এবারও মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল শোভাযাত্রায়। নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা ও কেন্দ্রীয় রাস্তা।

ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফী‌কে পু‌ড়ি‌য়ে হত্যা এবং চকবাজা‌র ও বনানী‌তে অগ্নিকা‌ণ্ডে অ‌নেক মানুষ মারা যাওয়ার প্রেক্ষাপ‌টে এবা‌রের বর্ষবরণ উৎস‌বে র‌য়ে‌ছে তার ছাপ। উৎস‌বে শা‌মিল মানু‌ষের স্মৃ‌তি‌তে এখনও জ্বলজ্বল এসব ঘটনা। তাই কথা বল‌লেই উ‌ঠে আস‌ছে প্রসঙ্গগু‌লো।

‌মোহাম্মদপুর থে‌কে মঙ্গল শোভাযাত্রায় এ‌সে‌ছেন বেসরকা‌রি চাকরজীবী মে‌হেদী হাসান। তি‌নি ব‌লেন, ‘নুসরা‌তের মৃত্যু আমা‌দের ব্য‌থিত কর‌ছে। প‌হেলা বৈশা‌খে আমা‌দের প্রত্যাশা ঐক্যবদ্ধভা‌বে সকল অপশ‌ক্তি ও অশুভ‌কে রু‌খে দি‌য়ে মু‌ক্তিযু‌দ্ধের চেতনায় শোষনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া।’

যাত্রাবা‌ড়ি থে‌কে এক মে‌য়ে, স্ত্রীসহ সপ‌রিবা‌রে শাহবাগ এসেছে‌ন ব্যাংক কর্মকর্তা শাহাদাত হোসাইন। তি‌নি ব‌লেন, ‘প্র‌তি বছরই মঙ্গল শোভাযাত্রায় আসার চেষ্টা ক‌রি। অসাম্প্রদা‌য়িক চেতনার এক‌টি বড় স্থান এই শোভাযাত্রা। সাম্প্র‌তিক স‌হিংস প্রেক্ষাপ‌টে এই চেতনার বিকাশ বে‌শি জরু‌রি।’

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।

শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ছিল না। তখন এর নাম ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।

বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে।

যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন সৃষ্টি করে।

যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।

আরএমএম/এসআর/এমএস