গত ক’দিন ধরে বিকেল বেলা অরলান্ডোর আকাশ জুড়ে কালো মেঘ নেমে আসে প্রথমে। তারপর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো। সে সময়টাতে আমি দীঘির পাশের খোলা উঠোনে বসে থাকি। ঝড় বৃষ্টির স্পৰ্শ অনুভব করি। এ সময়টা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যেকোনো সুখকর স্মৃতির মতোই এ অনুভূতিও ক্ষণস্থায়ী। এর পরপরই মেঘের পাশে রোদ ওঠে।
Advertisement
আজ বিকেলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আকাশ ভেঙে পড়া বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে আমার চোখে মুখে। এই অসাধারণ ঘোরের মাঝে নরম্যানের কথা ভাবছি।
নরম্যান আজ এসেছিলো। ও আমার দীর্ঘদিনের চেনা। একজন বোহেমিয়ান প্রকৃতির শিল্পী মানুষ। চেহারাতেও তার ছাপ আছে। রবিঠাকুর কিংবা নির্মলেন্দু গুণের মতো লম্বা দাড়ি। জীবন যাত্রা খানিকটা আমাদের নড়াইলের এস এম সুলতানের মতো। একটি বিশাল রাঞ্চে একা থাকে। একগাদা ছাগল আছে তার। ছোট ছোট ‘পিগমি ছাগল’। ওর বাড়ির চারদিকে ওরা ঘুরঘুর করে।
ছবি এঁকে জীবন কেটে যায় তার। বছরে একটি মাত্র ছবির প্রদর্শনী করে সে নিউ ইয়র্কে। সেখানে বিক্রিত ছবির উপার্জনে চলে যায় তার খেয়ালি জীবন। আমি তার মিশ্র মাধ্যমের কিছু কাজ দেখেছি। তার শিল্পীয়ানাতে আমি মুগ্ধ।
Advertisement
ছবির বোদ্ধা নই আমি। তবে ওর ছবিগুলো আমার কাছে অসাধারণ লাগে। ওর ছবিতে একটি জীবনের গল্প থাকে।
নর্থ ডাকোটার ছোট্ট এক শহরে ওর জন্ম। নরম্যানের বাবা ছিল মদ্যপ। প্রায়ই তার মাকে ধরে পেটাতো মাতাল অবস্থায়। ছ’ ভাই বোনের বিশাল পরিবার তার মাকেই টানতে হতো। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য ওর মা একটি রেস্তোরাঁতে দিনরাত কাজ করতো। সব কটি ভাই বোনের ছিল মানবেতর জীবন।
ওর বয়স তখন সাত বছর। অনাহার কিংবা অর্ধাহারে তার দিন কাটে। একরাতে তার মাতাল বাবা ঘরে এসে তার মাকে না পেয়ে তাদের সবাইকে মারধোর করলো। পরদিন নরম্যান স্কুলে যাবার পর ওর শিক্ষক ওর মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে ওকে জানতে চাইলো কী হয়েছে? সে সব খুলে বলতেই সে শিক্ষক ‘শিশু প্রতিরক্ষা বিভাগকে’ জানিয়ে দিলো সবকিছু । তারা এসে তাদের বাড়িতে সব কিছু দেখে তার বাবা মাকে সন্তান লালন পালনের অনুপযুক্ত ঘোষণা করলো। সব কটি ভাই বোনকে তারা বিভিন্ন পরিবারের কাছে দত্তক দিয়ে দিলো।
নরম্যানকে দত্তক নিলো উইসকনসিনের একটি ছোট শহরের নিঃসন্তান এক দম্পতি। খুব তাড়াতাড়ি সে টের পেয়ে গেলো যে তার দত্তক বাবা-মা দু’জনেই মাদক ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত। আস্তে আস্তে সে ও জড়িয়ে গেলো তাতে। বছর দশেক পর এক গভীর রাতে পুলিশ এসে ঘিরে ফেললো তাদের বাড়ি। ওর বাবা মার সাথে সেও গ্রেফতার হলো।
Advertisement
ওর নতুন আশ্রয় হলো একটি ‘অপ্রাপ্তবয়স্কদের সংশোধন কেন্দ্রে’। এখানে এসে জীবনের মোড় ঘুরে গেলো তার। সংশোধন কেন্দ্রের কঠিন পরিশ্রমের পর সেখানকারই এক শিক্ষকের কাছে তার শিল্পচর্চার হাতেখড়ি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তার। এ শহরে এসেছে এক যুগ আগে। শহরের খানিকটা বাইরে একটা রাঞ্চের মাঝে তার বাড়ি আর ছবি আঁকার ঘর।
অনেক বছর ধরে মাকে খুঁজছে সে। গত সপ্তাহে তার মায়ের খবর পেয়েছে। পোর্টল্যান্ডের এক ফার্মে তার মা থাকেন। আজ সকালে খুব খুশিমনে আমাকে জানিয়ে দিলো গেলো সে। আগামী পরশু তার মাকে দেখবে সে চার যুগ পরে। তার চোখে মুখে একটি স্বর্গীয় হাসি।
কালবৈশাখী ঝড়ের বৃষ্টির ঝাঁপটা কমে গিয়েছে এর মাঝে। মেঘের নিচে সূর্য উঁকি দিচ্ছে।
বাংলা নববর্ষের শুরু আজ। বৃষ্টির পর অনাহুত সূর্যের আলোতে এ মনটা এক অজানা আনন্দে ভরে আছে। নরম্যানের আনন্দে আমার বাংলা নববর্ষের এ শুভ ক্ষণটি আরো আনন্দময় হয়ে গেলো।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
এসএইচএস/এমএস