ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগতে কে চায়? কিন্তু বাঙালির ইতিহাসের হৃদয় জুড়ে হাজারও বেদনার স্মৃতি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন, ক্ষত কোথায় নেই! এমন কী স্বাধীন বাংলাদেশের হৃদয় জুড়ে হাজার ক্ষত। যা মনে পড়লে বাঙালির কণ্ঠে চাপা গোঙানি ছাড়া অন্য কোন শব্দ শোনা যায় না। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন এক উৎসব। সেখানেও রক্ত আর বেদনার কাব্য!
Advertisement
স্বাধীনতার আগে এই ভূ-খণ্ডে রবীন্ত্রনাথ নিষিদ্ধ হলেন। রবীন্ত্র চর্চা বলা শুরু হিন্দু সংস্কৃতির ধ্বজা! পাকিস্তান টেলিভিশনে ষাটের দশকের শেষ দিকে পঞ্চ কবিকে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো পাঁচ দিনের। কিন্তু নিষিদ্ধ এক শব্দ হয়ে দাঁড়লো রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বাঙালির মন-মননে রবীন্দ্রনাথ। তাই পাকিস্তানি শাসকদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র চর্চা চালিয়ে যেতে পিছপা হলো না এদেশের বাঙালি সংস্কৃতি কর্মীরা।
বাংলা নববর্ষ বরণের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র চর্চার অন্যরকম এক মঞ্চ তৈরি হলো না। ধীরে ধীরে ছায়ানট রমনার বটমূলকে বাঙালির বর্ষ বরণের মূলকেন্দ্রে পরিণত করলো। 'এসো হে বৈশাখ এসো হে' লাখ বাঙালির কণ্ঠে ধ্বনিত হতে শুরু করলো। ওটাই হয়ে দাঁড়ালো বাংলা নববর্ষের থিম সং।
কিন্তু বাঙালিকে যারা ঠিক পরিশুদ্ধ বাঙালি হিসেবে দেখতে চায় না, তারা থেমে থাকেনি। তাই বাংলা ভাষার পর বাঙালির সংস্কৃতির ওপর নতুন করে আবার হামলা। হামলা করা হলো বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে। বাঙালি সংস্কৃতির মর্মমূলে আঘাত করা হলো রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে রক্তাক্ত করে।
Advertisement
২০০১ সালে রমনার বটমূলে হামলা হলো। অনেকগুলো প্রাণ গেলো। অনেক মানুষ রক্তাক্ত হলো। আসলে অপচেষ্টা করা হলো বাঙালি জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু করার জন্য। সেও দেড়যুগ আগের ঘটনা। তারপর নতুন বছর আসে। বাঙালি বর্ষবরণ করে। রমনার বটমূলে ফিরে যায়। কিন্তু মনে এক অজানা আতঙ্ক। আবার কোন হামলা হবে না তো!
সরকার, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দৃঢ়তা আর সতর্কতায় গত দেড় যুগে হয়তো রমনায় হামলা হয়নি। কিন্তু রমনা হামলা, যশোরের উদীচী হামলা সুষ্ঠু তদন্ত আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কী নিশ্চিত করা গেছে, যে কারণে অজানা আর কোন আতঙ্ক বাঙালির বর্ষবরণের ছায়াসঙ্গী হবে না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বিশ্বের মঙ্গল কামনা করে সব অপশক্তি আর অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চারের আহ্বানের মধ্যে দিয়ে এখন প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। সেটা শুধু এখন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নেই। গোটা দেশে সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আবহ তৈরি হয়। বুকের ভেতর ধুক ধুক করে অজানা আতঙ্কে। বর্ষবরণ এখন গোটা দেশজুড়ে। বাঙালি ফিরে যেতে চায় তার শেকড়ে। অন্তত একটা দিনের জন্য হলেও। তবে সংশয়, দ্বিধা, নিরাপত্তাহীনতায় মোড়ানো এক আতঙ্ক সঙ্গী হয়ে থাকে তার।
মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। বাঙালির হাজার বছরের সভ্যতা আর সংস্কৃতির বিকাশের জন্য একদিনের এই বাঙালিয়ানা মোটেও যথেষ্ট নয়। কী পাশ্চাৎমুখী সংস্কৃতির দিকে দিনে দিনে ঝুঁকে পড়ছে বাঙালি। সেখান থেকে তাদের ফেরাবে কে?
Advertisement
বাংলা নববর্ষ ঘিরে বাঙালির অর্থনীতিরও বিকাশ ঘটছে। নতুন কাপড়, রং চং বিজ্ঞাপনে সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে আমাদের এই সর্বজনীন উৎসব। পান্তার সাথে ইলিশের কী সম্পর্ক, সেটাও এখন কিছু সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন? এই প্রশ্ন যত বেশি মানুষের মনে জাগবে, বাঙালি ততো বেশি সচেতন হবে তার শেকড় খোঁজার জন্য।
মুনাফা লোভী কিছু মানুষ আর কিছু টাকাওয়ালা এক দিনের বাঙালির হাত থেকেও বাঁচবে হাজার বছরের বাঙালিত্ব। বাংলার সংস্কৃতি। এই অপ্রিয় কথাগুলো অনেকের মনে পীড়া দিবে, তারপরও বলছি বাঙালিকে বাঁচতে হলে বাঁচতে হবে তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে। অন্যকে অনুকরণ করে, আপাতত সুখের সাগরে ভাসার একটা চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু তাতে কোন স্বাধীন জাতির নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। যার নিজস্ব কিছু নেই, তাঁর বিকাশও সম্ভব নয়।
আমরা এখন বিশ্ব নাগরিক হওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছি । তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেই দৌড় নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে করতে গেলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাঙালির ইতিহাস বলে; তার বুক জুড়ে, যতোই ক্ষত থাকুক, তার হৃদয়ে যতোই বেদনা জমা থাকুক, তবু সে উঠে দাঁড়ায়। নিজের আত্মপরিচয়কে বিশ্বে তুলে ধরার জন্য। যুগে যুগে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। কিন্ত বাঙালি থমকে যায়নি। নতুন বর্ষে বাঙালির সেই আত্মপরিচয় তুলে ধরার যাত্রা আরো বেগবান হবে। সেটাই প্রত্যাশা।
লেখত : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমএস