আন্তর্জাতিক

সুদানে যেভাবে একনায়কের পতন ঘটল

সুদানে যে গণবিক্ষোভে বৃহস্পতিবার ৩০ বছরের একনায়ক শাসনের অবসান হয়েছে তার নেতৃত্ব কোনো রাজনৈতিক দলের হাতে নেই। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে সুদানিজ প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ) নামে একটি পেশাজীবী সংগঠন। মূলত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং আইনজীবীরা মিলে এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন।

Advertisement

নারীরা ছিল ৭০ ভাগ

সুদানের এবারের গণ-বিক্ষোভে নারীদের যেরকম ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা গেছে, তার নজির বিরল। বলা হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের ৭০ শতাংশই নারী। সমাজের সব অংশ থেকেই নারীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। রাস্তায় তারা যেমন সোচ্চার তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একইভাবে তৎপর।

বিক্ষোভকারী এই নারীদের বিরাট একটা অংশ যে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছেন তা নয়, সুদানে শরিয়াহ আইনের পরিবর্তন চান তারা। দেশটির রক্ষণশীল সমাজে নারীদের বিরুদ্ধে নানানভাবে বৈষম্যমুলক আচরণের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্যে স্লোগান তুলছেন তারা।

Advertisement

সামাজিক সংস্কারের দাবিতে তোলা এক নারীর স্লোগানের ভিডিও টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে কয়েক লাখ শেয়ার হয়েছে। সেই নারী এখন সুদানের গণআন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তিনি ‘কানদাকা’ বা ‘নুবিয়ান কুইন’ খেতাব কুড়িয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের সিংহভাগই তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী। তবে বিভিন্ন বয়সের লোকজনও অংশ নিয়েছে।

বিক্ষোভ শুরু হলো যেভাবে

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরের সরকারের ওপর গত কয়েক বছর ধরে চলা মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সুদানের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়েছে। তেল রপ্তানি থেকে আয় দিন দিন কমছে। ২০১৭ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০১১ সালে সাউথ সুদান বিচ্ছিন্ন স্বাধীন হয়ে গেলে অধিকাংশ তেল-ক্ষেত্র হারায় সুদান।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেশ কিছু ব্যয় সঙ্কোচনের কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকার। অনেক ভর্তুকি কমানো হয় বা প্রত্যাহার করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য সুদানের মুদ্রার বড় ধরণের অবমূল্যায়ন করা হয়।

Advertisement

কিন্তু সরকারের এই কর্মসূচিতে হিতে-বিপরীত হয়। রুটি এবং জ্বালানি তেলের ভর্তুকি ওঠানোর পরিণতিতে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড চাপে পড়ে। প্রথম দেশের পূর্বে বিক্ষোভ-অসন্তোষ শুরু হয়। দ্রুত সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী খার্তুমে।

কীভাবে বিক্ষোভের দাবি বিস্তৃত হলো?

প্রথমে বিক্ষোভের প্রধান ইস্যু ছিল অর্থনৈতিক দুর্দশা যেমন বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও অপর্যাপ্ততা। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিক্ষোভের প্রধান দাবি হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্ট বাশিরের পদত্যাগ আর তার ৩০ বছরের শাসনের অবসান।

জনবিক্ষোভ চূড়ান্তে পৌঁছে গত ৬ এপ্রিল। সেদিনটি ছিল সুদানে আরেক স্বৈরাচারী শাসকের উৎখাতের বার্ষিকী। ১৯৮৫ সালে অহিংস এক গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন একনায়ক শাসক জাফর নিমেরি। কারফিউ অবজ্ঞা করে হাজার হাজার লোক জড়ো হয় সুদানের সেনা সদর দপ্তরের কাছে।

সেনা সরকারে কী মানুষ খুশি?

এক কথায় উত্তর হলো না। বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরকে সরিয়ে ক্ষমতা নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পরপরই সুদানিজ প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ) কারফিউ ভেঙ্গে সেনা সদর দপ্তরের বাইরে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়।

এসপিএ অভিযোগ করছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সেনা অভ্যুত্থান করেছে। তাদের কথা, এই সেনা শাসকরা থাকলে দেশে কোনো পরিবর্তনই হবেনা।

সেনাবাহিনীর জেনারেলরা কী বলছেন?

প্রেসিডেন্ট বাশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই সামরিক কাউন্সিলের প্রধান হন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লে. জেনারেল আওয়াদ ইবনে আউফ। তিনি ঘোষণা দেন, তিন মাস সুদানে জরুরী অবস্থা থাকবে।

তারপর, দুই বছর পর সাধারণ নির্বাচন দেয়া হবে। কিন্তু বিক্ষোভ অব্যাহত থাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুক্রবার সামরিক কাউন্সিলের প্রধানের পদ থেকে জেনারেল আওয়াদ ইবন আউফ পদত্যাগ করেন। সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আবদেলরাহমান বুরহানকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করা হয়েছে।

বিক্ষোভ প্রশমিত করতে সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, দুই বছর নয় পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে এক মাসের মধ্যেই বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া যেতে পারে।

সুদান সামরিক কাউন্সিলের রাজনৈতিক শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেলর ওমর জাইন আল-আবিদিন বলেছেন, ‘যারা বিক্ষোভ করছেন তারাই সমাধানের রাস্তা বাতলে দেবেন। জনগণই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমাধানের রাস্তা দেখাবে।’

ওমর আল বাশিরের কী হবে?

সেনাবাহিনী বলছে, ওমর আল বাশির তাদের হাতে বন্দী। অভ্যুত্থানের পর থেকে তাকে দেখা যায়নি। দারফুরে গণহত্যার অভিযোগে অনেক আগেই আন্তর্জাতিক আদালতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে সেনাবাহিনী বলছে তাকে সুদানেই বিচার করা হবে।

সূত্র : বিবিসি

এসএ/এমকেএইচ