মতামত

শুধু নুসরাতদের জন্য মোনাজাত করবো, প্রতিবাদ করবো না?

সবাইকে কি শিক্ষক বলা যায়, বলা উচিত? না মনে হয়। কেবল পাঠদান করলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলেই সে ব্যক্তি শিক্ষক নয়। শিক্ষকতো অভিভাবক, যার ভাবনাজুড়ে থাকে শিক্ষার্থীর ভালো-মন্দ। ভূত-ভবিষ্যৎ। শিক্ষকতো সে, যে মহৎ-মহান, আরেক জন্মদাতা। তাহলে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার সিরাজ-উদ-দৌলাকে শিক্ষক বলছি কেন? কেন বলছি নুসরাতের শিক্ষক তিনি। তিনি তো শিক্ষক নন, বিকারগ্রস্থ, বিকৃতকাম, যৌনলোলুপ- নরপশু।

Advertisement

যিনি মাদ্রাসায়, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেকে আড়াল করে, ছদ্মবেশ ধারণ করে দীর্ঘদিন ধরে নিজের যৌনবিকৃতি চরিতার্থ করে আসছিলেন। এই ছদ্মবেশীরা শুধু মাদ্রাসায় নয়, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, নার্সিং ইনস্টিটিউটে, মেডিকেল কলেজে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ইনিস্টিটিউটে, কৃষিবিদ্যা ইনিস্টিটিউটে, আইন মহাবিদ্যালয়ে- সর্বত্র।

কেউ কেউ মাদ্রাসার দোষ দিচ্ছেন। বলছেন, মাদ্রাসায় মেয়েরা নিপীড়িত হয়, নির্যাতিত হয়, যৌন হেনস্থার শিকার হয়, ধর্ষিত হয়। কিন্তু সত্য যেটি সেটি হলো- হয় না কোথায়? হয় সবখানে, ঘরে-বাইরে, যে যার মতো করে। এক শ্রেণির পুরুষতো থাকেই ওৎপেতে, মেয়েদের যৌন হয়রানি করবার জন্য। এর সঙ্গে মাদ্রাসা-অমাদ্রাসার সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক বদচরিত্রের। বদস্বভাবের।

বদকারগুলো, বদমাসগুলো জগতের যেখানেই থাকবে অসভ্যতা করবে, বর্বরতা করবে, না করতে পারলে নিদেনপক্ষে সুযোগ খুঁজবে। কেননা বিকাগ্রস্থদের মস্তিষ্কের নিউরনে ক্লিনিকালি বিকৃতি ঢুকে গেছে, বসবাস করছে। ফলে এরা যেখানেই থাক, যত উন্নত বা অনুন্নত, আধুনিক বা অনাধুনিক, উদার বা অনুদার সব পরিবেশেই- এরা তা করবেই।

Advertisement

মাদ্রাসার মেয়েদের আমরা অনগ্রসর, অনাধুনিক, অপ্রগতিশীল বলে মনে করি। বাস্তবতা সবসময় তা নয় কিন্তু। মাদ্রাসার মেয়েরা ধর্মীয় সংস্কারের কারণে মাথা ঢাকছে বলে সবসময় আপসকামী এমন ভাববারও যৌক্তিক কারণ নেই। গুলশান-বনানীর অনেক প্রাইভেট মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েও বলে না। লুকোয়, আড়াল করে। চেপে যায়, ঢেকে রাখে। এমনকি ধর্ষিত হলেও দিনের পর দিন।

নুসরাত কিন্তু তা করেনি। নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার ছাত্রী। মফস্বল ফেনীর সোনাগাজী এলাকার মেয়ে। কিন্তু সে আপোসকামী নয়। সে সাহসী। প্রতিবাদী। সে প্রতিবাদ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপশক্তির বিরুদ্ধে, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে। সে যৌন হয়রানি মেনে নেয়নি, আপোস করেনি। অভিযোগ করেছে, মামলা দিয়েছে। কেরোসিন আগুন তার মূল্যবোধকে, নৈতিকতাকে, সততাকে, সত্যবাদীতাকে পোড়াতে পারেনি। আমৃত্যু লড়ে গেছে সে অপশক্তির বিরুদ্ধে।

যেকোনো জীবাণুর সংক্রমণ বিস্তারলাভ করে অনুকূল পরিবেশে। সিরাজ-উদ-দৌলার মতো কীটরাও তাই। সে দীর্ঘদিন ধরে তাই করে আসছিল, যা সে নুসরাতের সঙ্গে করেছে এবং আরো বেশিকিছু করতে চেয়েছিল। প্রভাবশালী ব্যক্তি আর প্রসাশনের সমর্থন ছাড়া দিনের পর দিন কি করে একই অন্যায় সমাজে টিকে থাকতে পারে? তবে সিরাজ-উদ-দৌলা একা নয়। অসৎ মানুষেরা একা হয় না, বরং সৎ মানুষেরাই একা হয়। নুসরাত যেমন একা ছিল। একা লড়েছিল।

সরকারদলীয় কোন ব্যক্তিকে কেবল বহিষ্কার আর প্রত্যাহার করে নিলেই কি দায়িত্ব শেষ? পাপ পূণ্য হয়ে যাবে? সাতখুন মাফ, তা কি কখনও হয়? মানুষ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। দেখতে চায়, জানতে চায় সরকার তার দলীয় লোকদের কতটা শাস্তি নিশ্চিত করলো।

Advertisement

কারো মৃত্যু না হলে আমাদের হুঁশ হয় না, টনক নড়ে না। নুসরাত তো অনেক দিন ধরে চিৎকার করছিল। করছিল আর্তনাদ, আহাজারি। কিন্তু সেই পাথরভাঙ্গা আর্তনাদ কেন আমাদের কানে পৌঁছেনি। কেন এতো স্বেচ্ছাবধির আমরা? এই জনপদে যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণতো বেড়েই চলেছে তারপরও আমরা এতো বেহুঁশ কেনো?

আমরা কি তবে কেবল মৃত্যুর পর প্রার্থনা করবো, মোনাজাত করবো? দোয়া পড়বো? কবর খুঁড়বো, শাবল-গাইতিতে? কেন হত্যাকারীর বুকে ছুড়ি ধরবো না? কেন গুলি করবো না? কোন ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবো না অন্যায়কারী, অপরাধী, নিপীড়ক, নির্যাতক, যৌন হেনস্থাকারী, ধর্ষকদের?তবে আর কবে, আর কতো!!

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/জেআইএম