শিক্ষা

প্রাথমিকে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী

> ঝুঁকিপূর্ণ অধিকাংশ ভবনই ২০০১ থেকে ২০০২ সালে নির্মিত> বর্তমানে ৯ হাজার ৬৬১টি স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ> ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের দ্রুত তালিকা চূড়ান্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে

Advertisement

সারাদেশে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে। এসব ভবনের অধিকাংশই ২০০১ থেকে ২০০২ সালে নির্মিত। বাকি ভবনগুলোর বয়সও ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে এসব ভবন নির্মাণ করায় প্রাথমিকের লক্ষাধিক ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভবনগুলোর কোনোটির পিলার নড়বড়ে, কোনোটির ছাদ বা দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনগুলোর ছাদের অবস্থাও খুবই নাজুক। পলেস্তারা ওঠে রড বেরিয়ে পড়েছে। নতুন অনেক ভবনের দরজা-জানালাও নেই। কোনো বিদ্যালয়ে আবার বসার চেয়ার-টেবিলসহ সকল আসবাপত্রও নড়বড়ে।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি, সাবেক ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ) একজন সিনিয়র প্রকৌশলী জানান, যদি একটি ভবন নির্মাণে বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় হয়, তাহলে কিছুতেই তা ৫০ বছরের আগে সংস্কারের দরকার পড়ে না। ভবন ভেঙে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে, রড ছাড়া কাঠ-বাঁশের ব্যবহার এবং যথাযথ পরিমাণ বালু ও সিমেন্ট না ব্যবহার করা।

Advertisement

ঠিকাদার তো লাভ করতে চাইবেই, কিন্তু স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী নির্মাণকাজ নিশ্চিত করা প্রকৌশলীর দায়িত্ব। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে গ্রামের স্কুলগুলো এলজিইডি নির্মাণ করছে। শহরেরগুলো ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ ২০০০ সাল পর্যন্ত নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে। দেখা যাবে, ঢাকা শহরে ৮০ দশকে নির্মিত স্কুল এখন পর্যন্ত সংস্কারও করতে হয়নি।

আরও পড়ুন> ফের ধসে পড়ল স্কুলের ছাদ, অল্পের জন্য রক্ষা

তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে নির্মিত করাতিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে তৈরি মানিকদীতে অবস্থিত ব্রাহ্মণনগর এবং বাংলামোটরের খোদেজা খাতুন স্কুল অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু চুনকাম করলেই নতুনের মতো দেখায়। আমাদের নির্মাণ ব্যয় বেশি বলে এলজিইডিকে কাজ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু আসলেই কি কম টাকায় ভবন হচ্ছে?

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং মাঠপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির ভবন নির্মাণের সময় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। নির্মাণ শেষে স্কুলের পরিচালনা কমিটি এবং প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। গোটা কাজ তদারকি করেন উপজেলা প্রকৌশলী।

Advertisement

সার্বিক দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট ইউএনও। তবে হস্তান্তরের পর এসব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও তদারকির ভার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) জেলার গোটা শিক্ষার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এরপরও প্রাথমিকের ভবনগুলোর মরণ ফাঁদে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৬ এপ্রিল বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের বিম ভেঙে পড়ে একজন শিশু ছাত্রী নিহত এবং ৯ জন আহত হয়।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে সারাদেশের স্কুল ও এর শিক্ষার সার্বিক দিক তদারকি করানো হয়। তা সত্ত্বেও বরগুনার একটি স্কুলে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আমরা খুবই ব্যথিত। এ ঘটনায় ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে, তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই রেহাই পাবে না। তদন্ত কমিটি রোববার নাগাদ প্রতিবেদন দেবে। তার ভিত্তিতে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা সংগ্রহের কাজ চলছে। দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা চূড়ান্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো ভবন সংস্কারের সুযোগ না থাকলে তা পরিত্যক্ত করা হবে। বাকিগুলো সংস্কারে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুন> অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেন জজের দুই সন্তান

ডিপিই সূত্র জানায়, জরাজীর্ণ ও ভবন না থাকা স্কুলের সংখ্যা চিহ্নিত করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজের অংশ। এ লক্ষ্যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সম্পদ ব্যবস্থাপনা তথ্য ব্যবস্থা’ (পিইপিএমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারও আছে। তাতে সারাদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই আলোকে সংস্কার বা নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ৯ হাজার ৬৬১টি স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।

ডিপিইর এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো প্রকৌশল শাখা বা বিভাগ নেই। এ কারণে প্রাথমিক স্কুল ভবন নির্মাণ করে এলজিইডি। এক শ্রেণির ঠিকাদার সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে এসব ভবন তৈরি করেছে। ফলে নির্মাণের কিছুদিন পরই তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যাচ্ছে প্রাণ।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের দক্ষিণ চালিতা বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শেষ না করা সত্ত্বেও গোটা বিল ঠিকাদারকে দিয়ে দেয়া হয়। অভিযোগের পর ওই ঘটনা আমলে নিয়ে এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করে। এটি গত ১০ এপ্রিল এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সুলতান হোসেন ডিপিইকে অবহিত করেছেন।

আরও পড়ুন> আতঙ্কে রাজধানীর বহুতল ভবন মালিকরা

থানা শিক্ষা অফিসাররা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে তথ্য পাঠানো হলেও ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হয়। এছাড়া ভবন নির্মাণ ও তদারকি নিয়ে ডিপিই এবং এলজিইডির মধ্যে আছে সমন্বয়হীনতা। বিশেষ করে নির্মাণকালে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের পক্ষে শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। উপজেলা প্রকৌশলী নির্মাণ কাজ দেখভাল করেন আর নির্বাহী কর্মকর্তা বিল দিয়ে দেন। এ প্রক্রিয়ায় নির্মিত ভবনই কিছুদিন পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।

পৃথক প্রকৌশল বিভাগ গঠনের চিন্তাপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থ ব্যয় করে। নিজেদের প্রকৌশল বিভাগ না থাকায় ভবন নির্মাণ করে দেয় এলজিইডি। এর আগে এ মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণ করতো ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ। নিম্নমানের উপকরণে ভবন নির্মাণের ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিজস্ব বিভাগ বা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, আমরা ভবন নির্মাণের জন্য এ সংক্রান্ত বিভাগ বা অধিদফতর গঠন করবো। এছাড়া এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, দেশে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৬ হাজার ১৬৫টি পুরনো। এসব জরাজীর্ণ ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ২৬ হাজার স্কুল ভবন নতুন বলে জানা গেছে।

এমএইচএম/আরএস/জেআইএম