শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষক বদলিতে সক্রিয় দালাল সিন্ডিকেট

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে (ডিপিই) সক্রিয় দালাল সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে ডিপিইর কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বদলির জন্য ডিজি অফিসে শিক্ষকদের সঙ্গে রফাও করতে দেখা গেছে দালালদের। বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ডিপিইতে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় শিক্ষক বদলির জন্য ডিজি অফিসে উপচেপড়া ভিড়। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষক ও তার স্বজনরা বদলির জন্য এ ভিড় করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দালাল সিন্ডিকেট। দালালরা ডিপিইর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে শিক্ষকদের বদলির এ রফা করছেন। দুপুর ১২টায় ডিজি তার কক্ষে উপস্থিত হলেই দুই শতাধিক বদলি ইচ্ছুক ও দালাল সদস্য তদবির করেন। কেউ কেউ সুযোগ না পাওয়ায় বাগবিতণ্ডা করে। এতে ডিজি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। পরিস্থিতি সামাল দিতে এ কক্ষে উপস্থিত কর্মকর্তারা সবাইকে ধমক দিয়ে শান্ত হতে বলেন। পর্যায়ক্রমে সবাইকে সাক্ষাৎ করতে অনুরোধ জানানো হয়।

দেখা গেছে, এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আগত ব্যক্তিদের এক এক করে বদলির কারণ জানতে চান ডিজি। অধিকাংশের আবেদন জমা রাখা হয়। এরপর বেলা দেড়টার দিকে ডিজি অফিস থেকে রেবিয়ে যান। তিনি রেরিয়ে যাওয়ার সময়ও প্রায় ৫০ জন দর্শনার্থী তার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। ডিজির কাছে তদবির করতে না পারায় হতাশ হয়ে তাদের বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।

এদিকে দালালদের মাধ্যমে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বদলি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে এখনো যারা বদলি নিশ্চিত করতে পারেননি, বর্তমানে তারা দালাল সিন্ডিটেকের সদস্যদের সঙ্গে দুই থেকে ৪ লাখ টাকা চুক্তিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বদলি করতে ডিজি অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দালালরা তদবির করে চলছেন।

Advertisement

বদলিতে ‘দালালি কার্যক্রম’ জোরালো হয়ে উঠেছে বলে স্বীকার করেন ডিপিইর পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) খান মো. নুরুল আমিন। বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাপরিচালকের দফতরে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক বদলির জন্য দালালচক্র ঢুকে গেছে। দুই থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে প্রতিদিন বদলির জন্য তারা ভিড় করছে। এদের জন্য আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘নিয়মমাফিক প্রতিনিয়ত বদলি করা হচ্ছে। বদলির জন্য যথাযথ কারণ থাকলে আমরা সেটি গুরুত্ব দিয়ে বদলি অর্ডার করছি। আবেদন করলেই তো আর সবাইকে বদলি করা সম্ভব নয়। সবাইকে যদি জেলা শহরে বদলি করা হয় তবে হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কে থাকবে? সেসব স্কুলে কেউ যেতে চায় না, সবার নজর শুধু শহরের দিকে।’ সাধারণ প্রক্রিয়ায় অনেকের বদলি না হওয়ায় তারা এখন দালাল ধরে বদলির জন্য ধরনা দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে ডিপিইর একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির তদবিরে জড়িত রয়েছেন। এদের অধিকাংশই ডিজি দফতরে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ডিজির ব্যক্তিগত সহকারী ফিরোজ কবির অন্যতম। দালালদের সঙ্গে চুক্তিতে শিক্ষক বদলি করেন তিনি। এরপর দালাল সদস্যদের ডিজির কাছে পাঠান ফিরোজ। ডিজি সেখানে ব্যবস্থা নিতে লিখে দিলে বদলির পরবর্তী কাজ তার দায়িত্বে করে নেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কাজে তিনি ছাড়াও কয়েকজন অফিস সহকারীসহ আরও কয়েকজন সহায়তা করে থাকেন বলে জানা গেছে।

ফিরোজ কবিরের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, তিনি ২০১২ সালে সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকার সময় একটি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। পাশাপাশি তাকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার বড় ভাই একজন যুগ্ম-সচিব হওয়ায় ক্ষমতার জোরে মামলা থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে ডিপিইতে বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি ডিজির পিএস হিসেবে বদলি বাণিজ্য করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি একটি তদন্ত কমিটির প্রকাশ হওয়া অতিরিক্ত ভ্রমণ-যাতায়াত ভাতা আদায়ের অভিযোগ থাকলেও ক্ষমতার দাপটে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দেয়া হয়নি বলে তদন্ত কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফিরোজ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপনার যা ইচ্ছা লেখেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি কোনো দুর্নীতি করি না, শিক্ষকদের বদলিও করি না। তাই আমি ভয় পাই না, নিউজ লিখলে আমার কিছুই হবে না।’

জানতে চাইলে ডিপিইর মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির জাগো নিউজকে বলেন, ‘টাকা নিয়ে কেউ বদলি করতে পারবে না। বদলির জন্য আমি কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে একটি টাকাও নেইনি। আমার অফিসের কেউ যদি তা করে থাকে এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তাকে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঢাকাসহ বেশ কিছু জেলায় শিক্ষক বদলি করা হয়েছে। গত ৩১ মার্চ শিক্ষক বদলি কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আবেদনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এখনো কোনো কোনো জেলায় শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে।’ এ মাসজুড়ে বদলি কার্যক্রম চলবে বলেও জানান মহাপরিচালক।

এমএইচএম/এনডিএস/এমকেএইচ