মতামত

বেশ হয়েছে, নুসরাত মরেছে

মরে গেল নুসরাত, ভালই হয়েছে পোড়ামুখীটা মরেছে। কি হবে এই দেশে বেঁচে থেকে? কি হবে নিপীড়নের বিপক্ষে কথা বলে? আর কেউই বা শুনবে নুসরাতদের কথা। যে দেশে শত শত মানুষ যৌন নিপীড়নকারীর পক্ষে মিছিল করে, সেই দেশে না থাকাই ভাল।

Advertisement

মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে হেরে গেল মেয়েটি, চলে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে গতরাতে। আমরা কিন্ত ওর মৃত্যুর জন্য প্রস্ততই ছিলাম কারণ একজন মানুষের শরীরের সত্তর শতাংশ পুড়ে তার বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ থাকে। মরে যাওয়ার আগে ডাই ডিক্লেয়ারেশনে নুসরাত বলেছিল, তার বিরুদ্ধে যে যৌন নির্যাতন হয়েছিল তার প্রতিবাদ করার জন্যই তারা গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল এ মাসের ৬ তারিখে।

নুসরাত বলেছিল গত কয়েকবছর ধরে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করে আসছিল। সে নুসরাতের সাথেও এই রকম করেছিল। কিন্ত শেষপর্যন্ত মেয়েটি তার সাথে ঘটে যাওয়ার অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল, সে মামলা করেছিল।

মামলা করার পর থেকে সিরাজ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্ত নুসরাত তাদের কথা শোনেনি। সে মামলা তুলে নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে সিরাজের লোকেরা ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। নুসরাত বলেছে, "আমার যাই হউক না কেন, তার যেন বিচার হয়'। মরে যাবে জেনেও হার মানল মেয়েটি।

Advertisement

শিক্ষক কতৃর্ক যৌন নিপীড়ন খুব সাধারণ একটি ঘটনা এই দেশে। আমাদের স্কুলে একজন আরবী শিক্ষক ছিল। যেসব মেয়েরা পড়া পারতোনা তাদের পিঠে অন্তর্বাস ধরে টান দিয়ে থাপ্পড় মারত ওই লোক। এই ঘটনা ছিল ওপেন সিক্রেট, সবাই জানত কিন্ত কেউ কিছু বলত না।

নুসরাত এমন একটা সময়ে মারা গেল যে সময়ে দেশে একটি যৌন নির্যাতন বিরোধী ক্যাম্পেইন 'গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না' চলছিল আর তাতেই অনেকের গায়ে জ্বলুনি ধরে গেছে। অনেকের আসল চেহারা প্রাকাশিত হয়ে গেছে। ক্যাম্পেইনটা ছিল পাবলিক পরিবহনে মেয়েরা যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা নিয়ে সে কি তুলকালাম। কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছে। ভাবটা এমন এই দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মেয়েরা কি ধরনের হেনস্তার শিকার হয় তার কিছুই তারা জানে না।

কারো কারো ভাষ্য, কেন মেয়েদের বুকে কাপড় নেই। তাদের যেহেতু বুকে কাপড় নেই, সুতরাং তাদের হেনস্তা করাই যেতে পারে। লেখাগুলিকে এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে যারা, তারা কিন্তু আদতে নিজেদেরই স্বরূপই প্রকাশ করছে। এই যে আপনারা যারা আজ এই ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের সাথে ওই মাদ্রাসা শিক্ষকের কি কোন পাথর্ক্য আছে।

আমি বলছি না যে আপনার ওই মেয়েটির গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্ত আপনাদের আর তাদের মনস্তত্ত্বে কিন্ত খুব একটা ফারাক নেই। বুঝলাম মেয়েরা পর্দা করছে না, কিন্ত আপনি ভাই পর্দা করেন। ইসলাম ধর্মে তো চোখের পর্দা করার কথা বলা হয়েছে, তাহলে আপনার পর্দা থাকবে না কেন। আচ্ছা, নুসরাত তো পর্দা করত, বোরকা পরত তাহলে সে কেন রেহাই পেলনা। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো, পর্দা করলেও মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।

Advertisement

ও হ্যাঁ, তনু ও তো পর্দা করতো। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকেও ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়েছিল। পর্দা কি তনুকে বাঁচাতে পেরেছিল? পারেনি। আজ তিন বছর হয়ে গেল, তনু হুত্যার চার্জশীটটা পযর্ন্ত দাখিল করা হয়নি। আসলেই কি তনু হত্যার বিচার হবে? আচ্ছা, ছোট ছোট মেয়েগুলি যে ধর্ষণের শিকার হয় তাদের কি পর্দা করার কথা ধর্মে বলা হয়েছে। আর এই যে তিন, চার কিংবা পাচঁ বছরের মেয়েগুলি তাদের যৌন আবেদনটাই বা কোথায়।

তাহলে ঘটনা কি দাঁড়ালো, মেয়েরা দিনের পর দিন নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হবে কিন্ত প্রতিবাদ করতে পারবে না। নইলে, মেয়েরা যখন মি-টু প্লাটফর্মে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে লাগল তা নিয়ে সে কি প্রতিক্রিয়া। সেই সময় নিপীড়নকারীর নয়, ওই মেয়েগুলির চরিত্র নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেল। সেই নিপীড়কদের পক্ষে আমি আমার কাছের অনেক মানুষকে কথা বলতে দেখেছি যে আমার পায়ের তলের মাটি সরে গেছে।

আবার এই টি-শার্টের ট্যাগলাইন নিয়েও অনেক তথাকথিত প্রগতিশীলদের বিদ্রূপ করতে দেখেছি। এই যখন অবস্থা, তখন নুসরাতের তো মাদ্রাসার ওই সম্মানিত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ঠিক হয়নি। মেয়েটা বেশিই বেড়ে গিয়েছিল। ভাল হয়েছে ও মরে গেছে। জানিনা কি হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অপরাধীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলছেন। আশায় বুক বাঁধি এই ভেবে যে এই দেশে কিন্তু অনেক বছর পরে হলেও ইয়াসমিন হত্যার বিচার হয়েছিল।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/আরআইপি