মতামত

ফেসবুক ও এক তন্বীর গল্প

বছর কয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় একটি আর্টের টিউশনের সাথে যুক্ত ছিলাম। যাকে অঙ্কন শেখাতাম তার নাম তন্বী (ছদ্মনাম, সঙ্গত কারণেই নামটি গোপন রাখতে হচ্ছে)। পড়তো চতুর্থ শ্রেণিতে। তারা দুই বোন, এক ভাই। সবার ছোট তন্বী। একদিন টিউশনে গিয়ে দেখি তার মন খুব খারাপ। কিছু না বলে আঁকাআঁকি শুরু করলাম। এরপর তন্বীকে আঁকতে দিয়ে আমি আমার মোবাইল ফোনে ফেসবুকের নোটিফিকেশনগুলো চেক করছিলাম।

Advertisement

এমন সময় সে বলে উঠলো- স্যার আপনিও? আমি বললাম, মানে? উত্তরে তন্বী বললো, আমি মোবাইল একদম সহ্য করতে পারি না। মোবাইল আমার শত্রু। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? সে বললো- আপনি কাল থেকে মোবাইল আনবেন না। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওর অঙ্কনে মন দিলাম। সেদিন ওর মন খারাপের জন্য আর কিছু বলা হয়নি।

পরদিন যখন অঙ্কন শেখাতে গেলাম সেদিন মাথা নিচু করে তন্বী আমার সামনে এলো। সচরাচর আমার সামনে ও এভাবে আসে না। আমিও কিছু বললাম না। টেবিলে বসেই মৃদু স্বরে ও বললো, সরি স্যার, কালকের ব্যবহারের জন্য। ওর সরস মন দেখে জিজ্ঞেস করলাম- কী হয়েছে তোমার? এরপর ও আমাকে যা বললো আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। চতুর্থ শ্রেণির একটি মেয়ে সে কিনা এতকিছু বোঝে, অনুভব করতে পারে।

তন্বী সেদিন বলেছিল, বছর দু-এক আগেও তার মা তাকে সকালের নাস্তা নিজে বানিয়ে দিতেন, তারপর খাইয়ে নিজে স্কুলে নিয়ে যেতো। কিন্তু মা এখন আর এসব করেন না। মা অনেক ব্যস্ত। বাসায় কাজের লোক নেয়া হয়েছে, তিনিই সব করেন। যদিও তার মা একজন গৃহিণী। বাবাকে সবসময় পায় না সে। কারণ, তার বাবা একজন ব্যবসায়ী। চাইলেই বাবা তাকে সময় দিতে পারে না। তার বড় বোনও তার সাথে আগের মত খেলাধুলা করে না, গল্প শোনায় না। তার বড় ভাইও তাকে আগের মত মহল্লার স্কুলের মাঠে কিংবা ছুটির দিনে পার্কে নিয়ে যায় না। সবার কাছে সে আবদার করে আগের মতই, কিন্তু তার কথা কেউ শোনে না।

Advertisement

তন্বীর মতে, তার মা সকাল হলেই নাস্তা বাদ দিয়ে মোবাইলে মর্নিং সেলফি তোলেন। এরপর তা ফেসবুকে পোস্ট করে সারাক্ষণ নোটিফিকেশন চেক করতে থাকেন। বছর দু-এক আগে তন্বীকে তিনিই স্কুলে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তন্বীকে এখন স্কুলে নিয়ে যায় তাদের নিজস্ব গাড়িচালক। তন্বীর বড় ভাই এসএসসি পাসের পর নিজের আবদারে দামি ব্র্যান্ডের এন্ড্রয়েট ফোন নিয়েছে তার বাবার কাছে।

খুলেছে নতুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সে তাই নিয়েই ব্যস্ত। তার বড় বোনও একই কাজে আসক্ত। বাড়িতে নিয়মমাফিক সবাইকে পায় তন্বী। কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের মত ব্যস্ত। মোবাইল ফোন আর ফেসবুকেই সারাক্ষণ তাদের চোখ আটকে আছে। অথচ তন্বী তাদের কাছে কোনো কিছুর আবদার নিয়ে গেলেই নাকি তাদের সময় নেই। সেদিন কিছু বলতে পারিনি আমি তন্বীকে।

এরপর থেকে লক্ষ্য করতাম তন্বী কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছিল।

সম্প্রতি তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল একটি মার্কেটে। তার মা ও তার ভাইবোন মিলে এসেছে কেনাকেটা করতে। এতদিন তন্বীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে । তবে তা গড়নে, ভাবে নয়। তন্বীর মুখটা এখনো গম্ভীর। সেদিন দেখা হবার পর তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করার পর বলেছিলাম, তোমার ফোন নম্বরটা দাও। উত্তরে সে বলেছিল, আমি ওই বাজে জিনিস ব্যবহার করি না। সেদিন আমার মনে যে উপলব্ধি হয়েছিল তা আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

Advertisement

ফেসবুক বিশ্ব সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট, যা ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিতে বিনামূল্যে সদস্য হওয়া যায়। এর মালিক হলো ফেসবুক ইনক। ব্যবহারকারীরা বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি হালনাগাদও আদান প্রদান করতে পারেন, সেই সাথে একজন ব্যবহারকারী শহর, কর্মস্থল, বিদ্যালয় এবং অঞ্চলভিক্তিক নেটওয়ার্কেও যুক্ত হতে পারেন।

মার্ক জাকারবার্গ হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তার কক্ষনিবাসী ও কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র এডওয়ার্ডো সেভারিন, ডাস্টিন মস্কোভিত্স এবং ক্রিস হিউজেসের যৌথ প্রচেষ্টায় ফেসবুক নির্মাণ করেন।

প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলাদেশেও ফেসবুক এখন ব্যবহারকারীদের হাতের নাগালে। ২০১৭ সালের তথ্যমতে, সারাবিশ্বে মাসিক সক্রিয়তার হিসেবে ফেসবুক ব্যবহারকারী সংখ্যা ১৮৬ কোটি পেরিয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। ইন্টারনেট নজরদারির ওয়েবসাইট ইন্টারনেট লাইভ স্ট্যাটাসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৪২ কোটি। অর্থাৎ বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫২ শতাংশই প্রতি মাসে অন্তত একবার ফেসবুকে ঢোকেন।

ফেসবুকের দেয়া ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে মোবাইল যন্ত্র থেকে ফেসবুকে ঢোকার হার প্রতি বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসে মোবাইল থেকে অন্তত একবার ফেসবুকে ঢোকেন ১৭৪ কোটি মানুষ। মোবাইলে দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১৪ কোটি ৯০ লাখ। ফেসবুকের ২০১৭-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করেছে। বিশ্বের যেকোনো স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে টেনে নেয়ার মতো সুযোগ এই মাধ্যমটিই করে দিয়েছে। আর সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের এ জায়গাটি যতই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে ততটাই নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ ফেসবুকে প্রচুর সময় ব্যয় করার পাশাপাশি নিজেদের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ককে নীরবে বিচ্ছিন্ন করছে।

প্রযুক্তি বা ফেসবুক আসক্তি আপনজনদের মধ্যে সম্পর্কের দৃঢ়তাকে নষ্ট করে দেয়। এ আসক্তির কারণে খুন হানাহানির ঘটনাও ঘটছে। সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিনিয়ত এমন খবর আমরা দেখতে পাই।

২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্রযুক্তি আসক্তি ও ফেসবুকে নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করার জন্য রাগে নিজের স্ত্রীকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করেন ভারতের পুনে শহরের বাসিন্দা ৩৪ বছর বয়সী রাকেশ গাঙগুর্দে (বিবিসি)।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ২৯২ জনের। ২০১৬ সালে এ সংখ্যাটা ৮শ’ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য অংশের। রেলওয়ের সূত্র বলছে, শুধু নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৪২ কিলোমিটার রেলপথে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এক মাসেই ট্রেন দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেলপথ পার হওয়ার সময়। এই দুই-তিনটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রযুক্তি আসক্তি আমাদের জীবনে রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে (ইত্তেফাক)।

এ ধরনের হাজারো খবর আর ঘটনা রয়েছে। যা বলে শেষ করা যাবে না। এই ধরুন, আজকাল সম্পর্কগুলো ফেসবুক সেলফি কিংবা ফেসবুক স্ট্যাটাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকে আবার নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা শুরু করেন যখন তিনি দেখেন তার ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে তার ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে নিজের দেয়া পোস্ট কিংবা ছবিতে লাইক কমেন্টের সংখ্যা। অনেকের সম্পর্ক মজবুত শুধু ফেসবুক সেলফি কিংবা ছবিতে। বাস্তবে সেই সম্পর্ক শুধুই মেকি ও গুরুত্বহীন হয়। বিপদের সময় এসব সম্পর্কের সীমানার মধ্যের মানুষগুলো কোনো সহযোগিতা বা বিশুদ্ধ সহমর্মিতা দানের জন্য কোনো কাজেই আসে না। কাজে আসে আপনজনরাই।

কিন্তু এসব প্রযুক্তি কিংবা সামাজিক মাধ্যম সেই আপনজনদের সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধনকে দূরত্বে রূপান্তরিত করছে। এখন আর ত্বন্নীদেরকে তাদের মায়েরা স্কুলে নিয়ে যায় না, এখনকার বড় ভাইয়েরা ত্বন্নীদেরকে খেলার মাঠে বা পার্কে বেড়াতে নিয়েও যায় না। এখনকার বড় বোনেরা ত্বন্নীদের জন্য সময় বের করতে পারে না। কারণ, ফেসবুকে কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ত্বন্নীর চাইতেও তাদের আপনজন রয়েছে! এবং তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু বাস্তবেই কী সেই আপনজনদের সংখ্যা বেড়েছে? নাকি ত্বন্নীদের সাথে মায়েদের, বোনেদের বা ভাইদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে?

আমার অনেক সহকর্মীদের বলতে শুনেছি, তারা স্বামী-স্ত্রী নাকি আগের মত আলাদা সময় একসাথে গল্প করে বা আড্ডায় সময় কাটায় না। কারণ, সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে যেটুকু সময় তারা পায় তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করতেই তাদের ফুরিয়ে যায়। অথবা রাতের জৈবিক চাহিদা মেটানো ব্যতীত তাদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব নেই বললেই চলে।

এসব কথা যে তারা নিজেদের প্রযুক্তি আসক্তির কথা স্বীকার করে বা বুঝে বলেন তা নয়, বরং নিজের অজান্তেই এসব কথা বলেন তারা। তাদের বাচনভঙ্গি এমন যেন এসব নেহাতই একটা সাধারণ বা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাস্তবে এর বিশ্লেষণ যে কতটা ভয়াবহ তা তাদের বোধগম্য নয়। অন্যদিকে প্রযুক্তি আসক্তদের তাদের আসক্তির বিষয়ে বোঝানোটাও অনেক কঠিন। কারণ, প্রযুক্তি আসক্তি আসক্তদের অনেকটা আগ্রাসী করে তোলে।

প্রযুক্তি আসক্তি এমনভাবে মানুষকে আসক্ত করছে যে, দুটি মানুষ একই বিছানায় শুয়ে আছে কিন্তু তাদের মধ্যে তারাই নেই। ভাবা যায় সম্পর্কের কি বিবর্তনই না ঘটছে!সম্প্রতি আমেরিকায় ‘প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলাফল’ বিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রযুক্তি আসক্তির ফলে সারাবিশ্বে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে আসক্তদের প্রায় ৪৭ শতাংশ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যারা ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগে প্রকাশিত অভিব্যক্তি ও ছবির সাথে বাস্তব জীবনের মিল নেই প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭৩ জনের। প্রযুক্তি আসক্তির ফলে খুন ও সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০ জন মানুষের।

অথচ এমন এক সময় ছিল, যখন নিজেদের সম্পর্কের মাত্রা ছিল বর্তমান সময়ের সম্পর্কের মাত্রার চেয়ে অত্যধিক গাঢ়। আমাদের মা কিংবা দাদিদের মুখে সম্পর্কের মধুর গল্প অনেকেই শুনেছি। কিন্তু বর্তমান সম্পর্কের গল্পে তিক্ততাই বেশি। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ৪ থেকে ৫ টি বিয়ে এবং সকলকে একসাথে নিয়ে সুখে সংসার করার গল্প আমরা সকলেই জানি (আমার উদ্দেশ্য বহু বিবাহকে উৎসাহ দেয়া নয়)।

আমার নিজেরই ৪ দাদি ছিলেন। যাদেরকে কখনোই বিবাদে জড়াতে দেখিনি। নিজেদেরকে একে অপরের বোনরূপে বসবাস করতে দেখেছি। সে সময় ছিল সম্পর্কের স্বর্ণযুগ। কিন্তু বর্তমান সময়ে দুটি মানুষ একসাথে বসবাস করছে কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো গাঢ় সম্পর্ক নেই, নেই একে অপরের প্রতি ইতিবাচক আসক্তি, সহমর্মিতা। কারণ, এখনকার প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সেলফি তুলে কিংবা ছবি পোস্ট করেই যেন সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করতে চায়।

যারা নিজেদের সম্পর্কের গাঢ়তা প্রমাণ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বা ছবি শেয়ার করেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের সম্পর্ক অনেকটাই ভঙ্গুর। তবে সকলের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাধারণত আসক্তরা ইন্টারনেটে ৫ ধরনের কাজে বেশি ডুবে থাকে। ১. অনলাইন গেম খেলা ২. সুপ্ত অথবা বিকৃত যৌনাকাঙ্খা মেটাতে পর্ণোগ্রাফির সাইটগুলো দেখা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়া, ইন্টারনেট শপিং, ৫. কেউ বা এমনিতেই ঘুরে বেড়ায় সাইবার দুনিয়ার অলি-গলিতে।

আসক্তরা দিনের বেশির ভাগ সময় একাকী ঘরে বসে কাটায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় ওয়েবে, তারা প্রিয়জনদের সময় দেয় কম। এ নিয়ে ঝগড়া, বাক-বিতণ্ডা লেগেই লাগে। আসক্ত ব্যক্তি কাজের ব্যাপারে মিথ্যা বলা শুরু করে। তার শরীর ও মনের ব্যাপক পরিবর্তন হয়। মেজাজ চড়া হয়ে যায়, ঠিকমতো ঘুমায় না, ওজন বেড়ে যায়, ঘন ঘন মাথা ব্যথা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা দেখা দেয়।

তবে আসক্তিই শেষ কথা নয়। প্রযুক্তি আমাদের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু এর ব্যবহার এর কল্যাণের ওপর নির্ভর করে। এবং এটি সম্পূর্ণই আমাদের ওপর নির্ভরশীল। তাই এর আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পথ আমাদেরকেই খুঁজতে হবে। ভাবতে হবে এটিকে নিয়ে।

আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে কী আপনার জন্য দরকার আর কোনটি দরকার নয়। সারাবিশ্ব যেখানে এগিয়ে চলছে সেখানে আপনার থেমে থাকা চলে না। কারণ আপনি থেমে থাকলেও সবাই আপনাকে ছেড়ে এগিয়ে যাবে। তাই আপনাকে ভাবতে হবে। নিজের প্রয়োজন বা লাভের অংক কষতে হবে। ভাবুন তো, আপনি কখন কখন এসব অদরকারি মাধ্যম ব্যবহার করছেন এবং কত সময় ব্যবহার করছেন। কিংবা এর ব্যবহারে আপনার কী লাভ? আগেই বলেছি যেহেতু আপনি থেমে থাকলে বাকী সবাই এগিয়ে যাবে সেহেতু আপনার লাভ ক্ষতির হিসাব আপনাকেই করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে সময় ব্যবহার করছেন তা কি ব্যয় করা আপনার জন্য খুব জরুরি কিংবা এসব মাধ্যম ব্যবহার না করলে আপনার কি খুব সমস্যায় পড়তে হবে?

বরং এসব মাধ্যম ব্যবহার করার বদলে পরিবার পরিজনকে সময় দিন। এতে সম্পর্কের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি পাবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। যা বিপদের দিনে আপনার কাজে আসবে। অথবা প্রযুক্তি আসক্ততা তৈরি না করে সেই সময়ে এমন কিছু করুন প্রতিদিন যা আপনার জীবনের মোড়কে ঘুরিয়ে দেবে। কিন্তু প্রযুক্তি আসক্ততা আপনাকে এর কোনটিই দেবে না। বরং কেড়ে নেবে। আমরা কেউ চাই না ত্বন্নীর মত সবাই একা বা বিষন্ন জীবন যাপন করুক। চাই না সম্পর্কগুলো যেন প্রযুক্তির কাছে জিম্মি হয়ে না যায়।

আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কথা বলছি না। তবে এর সীমিত এবং নিয়মমাফিক সঠিক ব্যবহারের কথাই বলছি। প্রযুক্তি আসক্তি সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে আমেরিকার ওয়াশিংটনে সিয়াটলের কাছে ‘হেভেনসফিল্ড রিট্রিট সেন্টার’ ইন্টারনেট-আসক্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ আবাসিক চিকিৎসা পদ্ধতি শুরু করেছে। এটি সম্ভবত ইন্টারনেট-আসক্তদের জন্য প্রথম কোনো বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ও এতে আসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে। যদি এর নিয়ম মাফিক ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায় তবে এমন দিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশকেও প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট-আসক্তদের জন্য বিশেষায়িত আবাসিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা ভাবতে হতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

এইচআর/এমকেএইচ