বাবার অনুপ্রেরণায় ডানা মেলেছেন শৈশবেই। উড়ছেন এখনও। সেই যে শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে প্রকৃতির প্রেমে পড়া, সেই প্রেম সিদ্ধ করছেন হয়তো আফ্রিকার কোনো জঙ্গলে অথবা কোনো পর্বতের চূড়ায় মেঘের পরশে।
Advertisement
ভ্রমণই তার নেশা। ভ্রমণ নেশায় বিদেশের পেশা অনেকটাই চাপা পড়া। চাপা পড়েছে সংসার স্বপ্নও। বিশ্বরূপ দেখতে গিয়ে মানুষের রূপ দেখছেন আপন মনে, মানুষের মন খুঁজে ফিরছেন দেশ-দেশান্তরে। প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে হয়ে উঠেছেন একজন ভ্রমণপাগল মানুষ।
নাজমুন নাহার। বাংলাদেশের তরুণ পর্যটক। ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করে ইতোমধ্যেই রেকর্ড গড়েছেন। জীবনের সব স্বপ্ন দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছেন তার বিশ্বভ্রমণের পথ। ইচ্ছা, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে পা রাখার।
সম্প্রতি ভ্রমণ কথা মেলে ধরেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
Advertisement
জাগো নিউজ : সম্ভবত, আপনিই প্রথম বাঙালি, ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করে রেকর্ড গড়লেন। বিশ্ব ভ্রমণের পাখাটা ঠিক মেলেছিলেন কখন?
নাজমুন নাহার : বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকেই। প্রকৃতি আমার খুবই ভালো লাগে। শৈশবেই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। হারিয়ে যেতামও বটে। আকাশে পাখি উড়ে যেতে দেখে ভাবতাম, আমিও যদি পাখির মতো উড়ে উড়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারতাম।
আমি ভাবি, আমার জন্মই যেন হয়েছে বিশ্বভ্রমণের জন্য। ১২৫টি দেশ ঘুরেছি, স্বপ্ন বাকিগুলোও ঘোরার। ভ্রমণ কাহিনির কোনো লেখা পেলেই বারবার পড়তাম। তবে আমার এই ইচ্ছার পেছনে বাবার ভূমিকাই মুখ্য। শৈশবে বাবাই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। বাবা বলতেন, বিশ্ব হচ্ছে একটি পাঠশালা এবং সেখানে ছোটবেলা থেকেই নেমে পড়তে হবে। প্রকৃতির প্রেমে পড়ে বিশ্বভ্রমণের যে অনুপ্রেরণা, তা মূলত বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।
আরও পড়ুন > বিশ্ব জয়ের পথে নাজমুন নাহার
Advertisement
জাগো নিউজ : পরিবারের অন্যরা?
নাজমুন নাহার : পরিবারে সবার ছোট ছিলাম বলে আদরও বেশি পেতাম। অন্য ভাই-বোনেরাও বইপড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। আর আমি শৈশব থেকেই ডানপিটে ছিলাম। সাইকেল, ব্যাডমিন্টন আর মার্বেল খেলা নিয়েই আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে। পরিবার থেকেও আমাকে কোনো বাধা দেয়নি। ছেলে কী মেয়ে এমন বিভেদ আমার বেলায় হয়নি বললেই চলে।
জাগো নিউজ : আপনার বেড়ে ওঠা কোথায়?
নাজমুন নাহার : আমার বেড়ে ওঠা লক্ষ্মীপুর। শৈশব-কৈশোর গ্রামেই কেটেছে। স্কুলের এক স্যার আমাকে বিভিন্ন মানচিত্র খণ্ড খণ্ড করে দিতেন আর জোড়া লাগাতে বলতেন। আমি খুব দ্রুত ঠিক করে ফেলতাম। স্যার আমাকে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতেন। বাবার অনুপ্রেরণা আর স্যারদের আশীর্বাদ পেয়েই আমার পথ চলা। পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই আমার এই স্বপ্ন দেখা। ডানপিটে থাকলেও প্রচুর বই পড়তাম। পড়েই এক সময় লক্ষ্য স্থির করি, আমি বিশ্বভ্রমণ করব। এটি ছিল মনের বাসনা। অন্যরা জানতেন না।
জাগো নিউজ : ভ্রমণ শুরু করলেন কখন?
নাজমুন নাহার : আমার ভ্রমণ শুরু হয় ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এর আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। দেশের অনেক অ্যাডভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হই।
২০০০ সালে ভারতে যাওয়া ছিল আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে প্রায় ৮০টি দেশের তরুণরা অংশ নেয়। ভূপালে ছিল ওই প্রোগ্রাম। পাহাড়, বন আর নদীপথে ভ্রমণ দারুণ অভিজ্ঞতা দিয়েছিল আমাকে।
জাগো নিউজ : তখন বয়স কত ছিল?
নাজমুন নাহার : তখন আমার বয়স ১৭ কী ১৮ বছর হবে। ভারতের ওই প্রোগ্রামে যখন আমি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি, তখন মনের মধ্যে শিহরণ জাগে। তখন মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের পতাকা যদি আমি বিশ্বের প্রতিটি দেশে নিয়ে যেতে পারতাম!
ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে মনোবল আরও বাড়ে। এরপর আরও কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করি। ২০০৬ সালে আমি স্কলারশিপ নিয়ে সুইডেনের একটি ইউনিভার্সিটিতে যাই। আর সুইডেনে গিয়েই বিশ্বভ্রমণের ডানা আরও প্রসারিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন > দেশের পতাকা হাতে শততম দেশে বাংলাদেশের নাজমুন
সুইডেনে গিয়ে আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি। দিনে ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়েছি। ইউনিভার্সিটি যাওয়া, ভার্সিটি শেষ করে কাজে, কাজ শেষ করে ভাষা শেখার স্কুলে, এরপর রাতে বাসায় এসে প্রেজেন্টেশন তৈরি করা। খুব কঠিন সময় কেটেছে তখন।
এই কঠিনকে ভালোবেসেছিলাম বিশ্বভ্রমণ করব বলে। চাকরি থেকে টাকা পেলেই আমি আলাদা করে জমিয়ে রাখতাম এবং তা ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই রাখা।
জাগো নিউজ : সুইডেন থেকে কোন দেশে গেলেন?
নাজমুন নাহার : সুইডেন থেকে প্রথম ভ্রমণে যাই জাহাজে করে ফিনল্যান্ডে। এরপর পোল্যান্ড, জার্মানি, নরওয়েতে ভ্রমণ শুরু করি। এভাবেই ইউরোপে যাত্রা শুরু। তবে বেশির ভাগ দেশই আমি সড়কপথে ভ্রমণ করেছি।
জাগো নিউজ : তার মানে সুইডেন থেকেই ভ্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?
নাজমুন নাহার : ঠিক তা নয়। আমি শৈশব থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। আমার দাদা ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত আরবের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। আমি বাবার কাছ থেকে সেসব দেশ ভ্রমণের গল্প শুনতাম। বাবার গল্পগুলো আমাকে উৎসাহ জোগাতো। শৈশবের ভাবনার পথ বের হয় সুইডেনে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
বলতে পারেন, নিজেকে তৈরি করার সুযোগ এসেছিল স্কলারশিপ পেয়ে। স্কলারশিপ পাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই। আমার শিক্ষাজীবন থেকে ধীরে ধীরে শুরু। শিক্ষার প্রতি অনুরাগও আমার স্বপ্নজয়ে পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। সুইডেন থেকেই গবেষণার জন্য আমেরিকা গিয়েছি। এসব কারণে ভ্রমণের জন্য ভিসা পেতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। আর ইউরোপের দেশগুলো ভ্রমণের জন্য তো ভিসা জটিলতায় পড়তেই হয়নি।
জাগো নিউজ : বাবার অনুপ্রেরণার কথা বললেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ে কী বলবেন?
নাজমুন নাহার : চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসা একজন নারীর জন্য সহজ নয়। বাবার বা পরিবারের সহায়তা থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা অত সহজ ছিল না। ঠিক এখনও নয়।
জাগো নিউজ : সহজ করছেন কীভাবে?
নাজমুন নাহার : পরিবার সঙ্গে ছিল বলে থোড়াই কেয়ার করিনি। আর আমি প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী। আমাকে কেউ কটূকথা বললে আমি তার কোনো প্রত্যুত্তর করতাম না। সমালোচকদের কাছ থেকে কৌশলে সরে এসে আমি আমার পথে এগিয়েছি। ডানে-বামে কে-কী বলছেন, তা না শোনার ভান করেছি।
কারণ, যদি অন্যের কথায় কান দিয়ে আটকে থাকতাম, তাহলে আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারতাম না। এক্ষেত্রে নীরবতাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে।
জাগো নিউজ : বিশ্ব দেখার প্রত্যয় নিয়ে ঘরের বাহির হয়েছেন। বিশ্ব কেমন দেখলেন?
নাজমুন নাহার : বিশ্বরূপ আসলে এক বাক্যে বলে দেয়া যায় না। পৃথিবীর রূপ অপূর্ব। আমি সংক্ষেপে বলি, পৃথিবী হচ্ছে একটি ‘ব্লু ডট’। মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে ব্লু ডটের মতই দেখায়। পৃথিবী হচ্ছে ‘মা’। এই মায়ের গর্ভ থেকে ভিন্ন ভিন্ন রূপের, ধর্মের, ভাষার মানুষ বেরিয়ে আসছে। ভিন্ন রূপের হলেও মানুষের রক্ত একই।
পৃথিবী আসলে এই রূপের কথাই বলে। একই আকাশের নিচে ভিন্ন ভিন্ন রূপের মানুষ, একই বাতাস পাচ্ছি, একই নদীর পানি পান করছি। পৃথিবী ঘুরে যেমন সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য দেখেছি, তেমনি মানুষের মাঝে আমি স্বর্গ দেখেছি। যদি বিশ্বভ্রমণে নেমে না পড়তাম, তাহলে এই স্বর্গ হয়তো দেখা হতো না।
এএসএস/এমআরএম/জেআইএম