দেশজুড়ে

ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে ফেরার কথা ছিল সোহেলের

ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ফায়ারম্যান সোহেলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে বার বার মূর্ছা মা হালিমা খাতুন।

Advertisement

এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপদের মুখে পড়েছে পরিবারটি। মৃত্যু খবর পেয়ে সোহেলের বাড়িতে ভিড় করছেন স্বজনরা। চারদিকে যেন কান্নার রোল। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ।

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কিছুতেই কান্না থামছে না সোহেল রানার মা হালিমা খাতুনের। চারদিকে কান্নার রোল।

ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামের দরিদ্র কৃষক নূরুল ইসলাম ও মোসা হালিমা খাতুনের চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সোহেল রানা ছিলেন সবার বড়। মাত্র তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিসে ফায়ারম্যান হিসেবে চাকরি নেন। সবশেষ গত ২৩ মার্চ বাড়ি এসেছিলেন সোহেল রানা। সেদিন ঢাকায় যাওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন, ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে শিগগিরই বাড়ি আসবেন। তবে এবার তিনি জীবন থেকেই নিলেন লম্বা ছুটি। প্রিয় সন্তানের মৃত্যু খবরে বুক চাপড়ে মাতম করছেন মা-বাবাসহ স্বজনরা।

Advertisement

নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা সোহেলের পরিবারের। একটি টিনের দোচালা ঘরে বাবা-মা, চাচা-চাচিসহ সবাই থাকেন গাদাগাদি করে। বাবা দীর্ঘদিন ধরে প্যারালাইসড। বাড়ির পাশের চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন। কিন্তু অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না সোহেল রানার। অটোরিকশা চালিয়ে আর প্রাইভেট পড়িয়ে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ২০১৪ সালে।

পরের বছরই যোগ দেন ফায়ার সার্ভিসে। তার আয়েই চলতো পরিবারের ভরণ-পোষণ ছাড়াও ছোট ভাইদের লেখাপড়া। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন স্বজনরা।

এলাকাবাসী জানান, সোহেল রানা অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের ছিলেন। বাড়ি এলে আশপাশের লোকজনের খোঁজখবর নিতেন।

চৌগাঙ্গা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান জানান, ছেলেটি খুবই অমায়িক ছিল। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় আমরা তাকে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করেছি। চাকরি পাওয়ার পর বাড়ি এলেই স্কুলের খোঁজখবর নিত।

Advertisement

গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন রানা। ২৩ তলা ওই ভবনে আটকা পড়া মানুষদের ল্যাডারের মাধ্যমে নামাচ্ছিলেন তিনি।

সোহেল যখন চার-পাঁচজন আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিচে নামাতে চান তখন উদ্ধারকারী ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত সিঁড়ি নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। তাই ল্যাডারের ওজন কমাতে একপর্যায়ে সোহেল ল্যাডার থেকে বেয়ে নিচে নামছিলেন। এরপর ল্যাডারটির ওজন কমে যাওয়ায় সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। এরপরই ঘটে সেই ঘটনাটি, যা তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিল। ল্যাডারের ভেতরে সোহেলের একটি পা ঢুকে যায়। এ ছাড়া তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচণ্ড চাপ লাগে। এরপর থেকেই সংজ্ঞাহীন সোহেল।

দুর্ঘটনার পরপরই সোহেল রানাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রতিদিন চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছিল না। পেটের ক্ষতের কারণে সমস্যা হচ্ছিল রানার।

সে কারণে সিএমএইচের চিকিৎসকদের পরামর্শে গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) রানাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুর। তার দেখাশোনা করার জন্য ফতুল্লা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রায়হানুল আশরাফকেও তার সঙ্গে পাঠানো হয়।

সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

এফএ/এমকেএইচ