মতামত

আমাদের সন্তান যেন থাকে নিরাপদে

রোববারের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা দেখলে চমকে যাবেন যে কেউ। পত্রিকাটির শিরোনাম 'মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা'। শীর্ষ সংবাদের সাথে আরেকটি ছোট সংবাদ 'মাদারীপুরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ, নোয়াখালীতে ধর্ষণের শিকার শিশু।' এবার চলুন এই পত্রিকার পেছনের পাতার শীর্ষ সংবাদটি দেখে আসি, 'স্কুলের ছাদ খসে শিশু নিহত, আহত আরও আট শিক্ষার্থী।'

Advertisement

কী বিষণ্ণ গণমাধ্যম, কী ভয়ঙ্কর সময়। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীটিকে গত ২৭ মার্চ সেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা অফিসে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় মামলায় পুলিশ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেপ্তার করে। তারপর থেকেই সিরাজউদ্দৌলার লোকজন সেই ছাত্রী ও তার পরিবারের ওপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছিল। তারা রাজি হয়নি।

শনিবার মেয়েটি মাদ্রাসায় গিয়েছিল আলিম পরীক্ষায় অংশ নিতে। মেয়েটির নিরাপত্তা ঝুঁকিটা জানতো তার পরিবার। তাই ভাই প্রতিদিন বোনকে মাদ্রাসায় পৌঁছে দিতো। কিন্তু শনিবার ভাইকে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি। আর মেয়েটিকে ভুল বুঝিয়ে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে বোরকা পরা কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দেয়। রাজি না হওয়ায় তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মেয়েটি এখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। ডাক্তাররা তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

Advertisement

মাদ্রাসা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত নয়। সেখানে মূলত ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। তেমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে যদি আমার সন্তানের সম্ভ্রম নিরাপদ না হয়, আমরা কোথায় যাবো? আমাদের কন্যাদের কি আমরা ঘরে বন্দী করে রাখবো? এ কেমন দেশ, এ কেমন সমাজ? শুধু মাদ্রাসায় নয়, আমাদের কন্যা, আমাদের বোন কোথাও নিরাপদ নয়।

ধর্ষণের খবর শুধু রোববারের পত্রিকায় নয়, প্রতিদিনের পত্রিকার নিয়মিত সংবাদ। ধর্ষণ যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। সিঙ্গেল কলাম সংবাদেই দায়িত্ব সারে গণমাধ্যম। কিন্তু সেই নারীর জন্য এ এক সারাজীবনের বিভীষিকা।

ধর্ষণের ঘটনা তবু সিঙ্গেল কলাম হলেও পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু ঢাকার রাস্তায়, শপিং মলে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আমাদের কন্যা, আমাদের বোনেরা প্রতিদিন যে হেনস্থার শিকার হয়; তার তো কোনো নিউজ ভ্যালুও নেই। নারীদের নিত্যদিনের এই অপমানের, নির্যাতনের কোনো পরিসংখ্যান নেই। প্রতিদিন কত মেয়ে বাসায় ফিরে লজ্জায়, অপমানে কাঁদেন; বেঁচে থাকাকে বোঝা মনে করেন; তার খবর আমরা কতটা জানি।

আমি জানি ফেনীর সিরাজউদ্দৌলার মত কুলাঙ্গার শিক্ষক খুব বেশি নেই দেশে। ঢাকার রাজপথে, বাসে, মার্কেটেও খারাপ লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা সুযোগ পেলেই মেয়েদের হেনস্থা করে, বাসে একা পেলে ধর্ষণ করে। এখন এদের ভয়ে তো আমাদের মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে না। এই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধটা গড়তে হবে সম্মিলিতভাবে। বাসে বা মার্কেটে কোনো নারী হেনস্থার শিকার হলে সবাইকে তার পাশে দাঁড়াতে হবে।

Advertisement

দুদিন হলো ফেসবুকে একটি টি শার্ট নিয়ে তোলপাড়। 'গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না' এমন স্লোগান লেখা টি শার্ট পরে চলাফেরা করছে মেয়েরা। এর পক্ষে-বিপক্ষে ফেসবুকে তোলপাড়। পুরুষদের অনেকেই এই টি-শার্টকে অপমান হিসেবে দেখছেন।

আরে ভাই, আপনি সুযোগ পেলে মেয়েদের গায়ে হাত দেবেন, আর তারা সরে দাঁড়াতে বললে অপমানিত হবেন, এ কেমন কথা। আপনি খোঁচা মারবেন, আর মেয়েরা সরে দাঁড়াতেও বলতে পারবে না। তবে ভদ্র ভাষায় সরে দাঁড়াতে বললেই তারা সরে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। সাহস নিয়ে পুরুষ নামের এইসব কুলাঙ্গারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে হবে। সত্যিকারের পুরুষ যারা, তারা অবশ্যই এই লড়াইয়ে সামনের কাতারে থাকবে। নারী নয়, পুরুষ নয়; সবাই মিলে সব মানুষের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়তে হবে।

কিন্তু সেই নিরাপদ দেশ কবে পাবো? আট বছর বয়সী মানসুরা বরগুনার তালতলীর ছোটবগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। শনিবার ক্লাশ চলার সময় ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে মানসুরার মাথায়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে, আহত হয় আরো আট শিক্ষার্থী।

আমাদের সন্তানেরা কোথাও নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে লাশ হয়ে যায় আবরার। ঘরে-বাইরে সর্বত্র মৃত্যু যেন ওৎ পেতে আছে। আমাদের একমাত্র সন্তান প্রসূন আমিন। বড় হয়ে গেছে। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু তার মা সারাক্ষণ তাকে আগলে রাখে। কোথাও ছাড়তে চায় না। কেন চায় না বুঝি। মায়ের মন। আসলেই চারপাশে কত ফাঁদ পাতা কে জানে।আগে মায়েরা বলতো, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এখন দুধভাত পরে, আগে জান তো বাঁচুক। এখন একটাই চাওয়া, আমাদের সন্তান যেন থাকে নিরাপদে।

probhash2000@gmail.com

এইচআর/এমকেএইচ