দেশজুড়ে

মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দালালদের এ কেমন রসিকতা

প্রশাসনের কড়া নজরদারির মাঝেও থামানো যাচ্ছে না সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার চেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে মালয়েশিয়া পাচারে নিত্যনতুন পয়েন্ট আবিষ্কার করছে দালাল-রোহিঙ্গারা। গত এক সপ্তাহে পাচারের চেষ্টাকালে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

Advertisement

সর্বশেষ ৫ এপ্রিল টেকনাফের বাহারছড়ার সমুদ্র তীরবর্তী শামলাপুর এলাকা থেকে ১১৫ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ৫০ পুরুষ, ৩৯ নারী ও ২৬ জন শিশু রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পাচারকারী চক্রের মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় মানবপাচার চেষ্টা বন্ধ হচ্ছে না। ফলে সক্রিয় দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের ৩১টি ক্যাম্পভিত্তিক অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

তবে অবৈধভাবে বিপজ্জনক সাগর পথে পাচাররোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর বলে দাবি করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন।

Advertisement

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে জেলার টেকনাফ ও মহেশখালীতে অভিযান চালিয়ে ১৭১ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

গত বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের দেবাঙ্গাপাড়া পাহাড়ের চিকনঝিরি নামক এলাকায় দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে পানেরবরজ থেকে শিশুসহ ১৯ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এদের মাঝে দুই শিশু ও ১২ জন নারী রয়েছে।

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল ও ৩ এপ্রিল ) টেকনাফ বিজিবির সদস্যরা টেকনাফের মহেষখালীয়াপাড়া এবং সাবরাং কাটাবনিয়া সৈকত এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ২৭ জনকে উদ্ধার করে। এরা উখিয়ার কুতুপালং, জামতলী, থাইংখালী, বালুখালী, টেকনাফের মোচনী, লেদা ও শামলাপুর এলাকার রোহিঙ্গা শিবিরে বাস করছিল।

৩০ মার্চ সেন্টমার্টিন এলাকা থেকে ২২ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। এ সময় তিন দালালকে আটক করা হয়। আটক দালালরা হলো- সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা মোহাম্মদ কবির, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও মোহাম্মদ হোসেন।

Advertisement

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারীদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, অবিবাহিত নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার যেসব নারীর স্বামী মালয়েশিয়ায় তারাও যে কোনোভাবে মালয়েশিয়া যেতে উন্মুখ। আরাকানে (রাখাইনে) যাদের অবস্থা সচল ছিল সেসব পরিবার যেকোনো মূল্যে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মালয়েশিয়া যেতে তৎপর। অনেক তরুণী ও কম বয়সী বিধবা নারীই মালয়েশিয়া যেতে প্রতিনিয়িতই চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। যেকোনো দিন সুযোগ কাজে লাগলেই তারা সফল হবে বলে আশাবাদী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলিথিনের ঝুঁপড়ি ঘর থেকে বেরুতে চাওয়ার বাসনা জানা ক্যাম্পভিত্তিক দালালরা বিভিন্ন প্রলোভনে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি ক্যাম্পে থাকলে একদিন মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে বলেও ভয় দেখায়। যুবকদের ভালো বেতনের চাকরি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়। ফলে অনেক রোহিঙ্গা তাদের কথা মতো মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী হয়ে উঠে।

সূত্র আরও জানায়, মালয়েশিয়া যেতে রাজি হওয়াদের কাছ থেকে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা 'টোকেন মানি' আদায় করা হয়। চুক্তি হয় মালয়েশিয়া পৌঁছে গেলে বাকি টাকা দেয়ার। ক্যাম্পের দালালদের সঙ্গে সহযোগি হিসেবে রয়েছে সুযোগসন্ধানী বাংলাদেশি দালালও। রাজি হওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প হতে বের করে তাদের (বাংলাদেশি দালাল) হাতে তুলে দেয়া হয়। আর বাংলাদেশি দালালরা সুযোগ বুঝে ট্রলার বা নৌকায় সাগরে অবস্থান করা জাহাজে তুলে দেয়ার চেষ্টা চালায়। ক্ষেত্র বিশেষে তারা ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে সফল হয় বলে দাবি করেছেন মালয়েশিয়ার জন্য ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়া অনেকে।

অভিযোগ রয়েছে, মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে অনেক রোহিঙ্গা প্রতারণার শিকার হয়েছে। কোনো জবাবদিহিতা নেই জেনেই উদ্বাস্তু এসব রোহিঙ্গার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নেয় দালালরা। তারা সাগরে ট্রলার অপেক্ষা করছে উল্লেখ করে টাকা হাতায়। ধরা না পড়ে তীরে পৌঁছে গেলে পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাবার নামে ট্রলারে তুলে সাগরে দু-তিন দিন ঘুরিয়ে টেকনাফের কোনো না কোনো এলাকায় নামিয়ে দেয় এবং বলে যে, তারা মালয়েশিয়ার তীরে পৌঁছেছে। মাস খানেক আগে শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম চরে এমন একটি ঘটনায় অর্ধশত রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বিজিবি ও পুলিশ। পরে তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়।

অপর এক সূত্র মতে, জনপ্রতি টাকা হাতে চলে এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচিত কোনো বিভাগের সদস্যের তথ্য দিয়ে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের ধরিয়ে দেয়া হয়। এসময় দালালরা সটকে পড়ে। এতে কিছু না করেই একটি মোটা অংকের টাকা আয় হয় চক্রের।

সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ও প্রতারণার মাঝেও শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকে সাগর তীরেই মালয়েশিয়া যাত্রার ইতি টানলেও 'মানবপাচার' চেষ্টা থামছে না। তবে, পাচারের সঙ্গে জড়িত মূলহোতাদের গ্রেফতার করা না গেলে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচার বন্ধ হবে না বলে মনে করেন সচেতন মহল।

টেকনাফের ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সরকার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সীমান্তে যে কোননো অপতৎপরতা ঠেকাতে বিজিবির কঠোর অবস্থান রয়েছে। পাচারকারী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের আটক করার চেষ্টা চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

র্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর মেহদী হাসান বলেন, ক্যাম্পভিত্তিক গড়ে উঠা পাচারকারী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে। অনেক দালাল চিহ্নিত হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

জানতে চাইলে কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার শেখ মাহমুদ হাসান বলেন, দেশের সাগরপথ সুরক্ষা রাখতে কাজ করছি আমরা। সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার ঠেকাতে কোস্টগার্ড সজাগ রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন জানান, সাগরপথে যেসব পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচারের আশঙ্কা আছে, সেখানে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। খোঁজ নেয়া হচ্ছে পাচারকারীচক্রের সদস্যদের ব্যাপারেও। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/পিআর