কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা নিয়ে যত আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে, তা বোধকরি বিশ্বের অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে হয়নি। ১৯৯৬ সালে কাতারের আমির আল সানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্বের বেশ কয়েকজন নামকরা সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। যেহেতু মালিকানা রাজতন্ত্রের, তাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হিসেবে কোনো মতবাদের সমর্থক নয়, এমন ধারণা করাই স্বাভাবিক ছিল। প্রাথমিকভাবে এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট নীতির এই গণমাধ্যমটি প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে এ গণমাধ্যমটিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
Advertisement
পক্ষপাতদুষ্ট ও সহিংসতা সৃষ্টিতে উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচারের অভিযোগে আল-জাজিরাকে সর্বপ্রথম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আলজেরিয়া। একই বছর ইরাকও সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে তারপরও ইতিবাচক ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে, বিশেষত ২০১১ সাল থেকে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আসতে শুরু করে এবং বহু সাংবাদিক পদত্যাগ করেন।
বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে যে ধরনের তথ্য পাওয়া যায়, তাতে এটি শুধুই একটি গণমাধ্যম, নাকি গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কোনো গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে- এ প্রশ্ন উঠেছে বার বার! এ বিষয়টি যে উপেক্ষা করার মতো নয় তা বোঝা যায় আল-জাজিরা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৬২৪ নং রেজ্যুলুশনে, “Freedom of expression cannot be used to justify and shield the promotion of extremist narratives”
আল-জাজিরার নীতি ও লক্ষ্য
Advertisement
আল-জাজিরার সম্পাদকীয় নীতিমালা কি বা তারা কোন আদর্শ ধারণ করে- এর সুস্পষ্ট জবাব হচ্ছে, আল-জাজিরা, হাসান আল বান্না ও সৈয়দ কুতুব কর্তৃক ইসলামকে বিকৃত করে প্রদত্ত মতবাদ ‘হুকুম দখলই ইসলাম’ এ বিশ্বাসী। অর্থাৎ এটি মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলেমীনের মুখপত্র। মুসলিম ব্রাদারহুডের মতবাদে বিশ্বাসীরা অন্যান্য দেশে ভিন্ন নামে কার্যক্রম চালায়, যেমন- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়াতুল মুসলেমীন, লস্করে তৈয়বা এবং তুরস্কে একে পার্টি ইত্যাদি।
এই মতাদর্শের উদ্দেশ্য ইসলামী হুকুমত কায়েম নয়, বরং তাদের সমর্থিক দলের হুকুমত কায়েম। এসব দলের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন ও সমঝোতা আছে যে, প্রয়োজনে সকলে এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হবে। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন মতাদর্শের সাংবাদিকদের নিয়ে যাত্রা হলেও লক্ষ্য ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড সমমনা সংগঠনগুলোর সদস্য বা সমর্থকদের নিয়োগ দান করা। আল-জাজিরা সেই লক্ষ্যেই প্লাটফরম তৈরিতে অগ্রসর হয়েছে। এর সাড়ে চার হাজার কর্মীর উল্লেখযোগ্য অংশ ওই মতাদর্শের অনুসারী। ফলে কি ধরনের সংবাদ বা প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে, সম্পাদকীয় নীতিমালা কি হবে এ সম্পর্কে তাদের খুব বেশি ভাবতে হয় না।
আল জাজিরার সন্ত্রাসবাদে সংশ্লিষ্টতা
২০০১ এর টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচারের মাধ্যমে আলোচিত হয় আল-জাজিরা। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওমর আবদুল রহমান, ইরাকের হারিস আল দারি, ওয়াগদি ঘোনেম, আইএসের আবু মুসা আল জারকাবিসহ বিভিন্ন শীর্ষ জঙ্গিদের বক্তব্য ও আলোচনা প্রচার করে আসছে আল জাজিরা।
Advertisement
২০১৩ সালে আল-জাজিরা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দপ্তর চালু করে, অন্যদিকে আল-জাজিরার মধ্যস্থতায় জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদাও কাতারে দপ্তর খোলে। কাতার চ্যারিটি নামের একটি সংগঠন হয়ে ওঠে জঙ্গিদের আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান। এর সবকিছুই হয় আল-জাজিরার মধ্যস্থতায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেরোরিস্ট (SDGT) হিসেবে তালিকাভুক্ত আবদ আল রহমান আল নুয়াইমি আল জাজিরার অন্যতম নীতি নির্ধারক। নুয়াইমি এক দশক ধরে সিরিয়া, ইরাক, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে সহিংসতা সৃষ্টিতে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
কাতারের রয়েল ফ্যামিলির সদস্য ও আল-জাজিরার মালিকদের অন্যতম আল করিম আল সানি কর্তৃক আল কায়েদার ব্যাংক একাউন্টে এক মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার সংবাদ এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্র অপর একটি রিপোর্টে আল জাজিরা কর্তৃক আইএসকে ১.২৫ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়ার প্রমাণ রয়েছে।
মুসলিম ব্রাদারহুড, আল কায়েদা, আইএস, হামাস, হিজবুল্লাহ, আল নুসরা ফ্রন্ট, লিবিয়ান ফাইটিং গ্রুপ এ সকল জঙ্গি সংগঠনের মুখপত্রের ভূমিকা পালন করে আল জাজিরা। বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত জঙ্গিদের মধ্যে আল কায়েদার আনোয়ার আল আওলাকি, আল নুসরা ফ্রন্টের আবু মোহাম্মদ আল জোলানি, হামাসের খালেদ মাশাল, হাসান নাসরুল্লাহ, মোহাম্মদ দায়েফ, প্যালেস্টাইন জেহাদের রামাদান সাল্লাহ, লিবিয়ান ফাইটিং গ্রুপের আবদুল হাকিম বেলহাজসহ অনেক উগ্রবাদীদের সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখে আল জাজিরা।
আল-জাজিরার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
বাংলাদেশে আল জাজিরার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সকলেই কমবেশি জানি। ২০১৩ সালের ৫ই মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় সাধারণ একটি কবরস্তানের ভিডিও দেখিয়ে ও বাক প্রতিবন্ধী এক শ্রমিকের সূত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার লাশ দাফনের দাবি করা হয়, পরবর্তীতে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রোহিঙ্গা ইস্যু, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে একের পর এক উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল আল জাজিরায়। তবে এমন ঘটনা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটলে হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেত। সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমীরাত, সিরিয়া, মিশর, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশ আল জাজিরা নিয়ে উৎকন্ঠিত।
২০১১ সালে আরব বসন্ত নামে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের রাজপথে সংগঠিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আল জাজিরা। এ সময় উদ্দেশ্য প্রণোদিত, উস্কানিমূলক ও মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে পদত্যাগ করেন ২২ সাংবাদিক। সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে আল জাজিরার ভূমিকা সম্পর্কে সকলেই অবগত। ২০১৩ সালে ইরাক সরকার শিয়া সুন্নিদের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টিতে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে আল জাজিরা নিষিদ্ধ করে।
আত্মঘাতী হামলা করা বৈধ, জঙ্গিবাদ জান্নাতের পথ, খ্রিস্টান হত্যায় উস্কানি, ইয়াজেদি নারীদের ধর্ষণ করা জায়েজ এবং এক কপটিক পোপের হত্যায় উল্লাসসহ আল জাজিরায় অনেক বিতর্কিত বিষয় প্রচারিত হয়েছে। সম্প্রতি কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে প্রদর্শন ও উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচারের অভিযোগে আল জাজিরার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স বাতিল করেছে ভারত।
আল জাজিরা সম্পর্কে যারা এখন বিরূপ ধারণা পোষণ করেন, তাদের অনেকেই একসময় আল-জাজিরার প্রশংসা করতেন। যে দেশে আল-জাজিরার সদরদপ্তর, সেটি কিভাবে এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট নীতির ঊর্ধ্বে থাকে, ব্রাদারহুড সমমনারা সরকারে থাকলে কেন চোখ বন্ধ থাকে, এরদোগানের সাংবাদিক নির্যাতন-নীপিড়ন কেন বৈধ হয় - এসবের কোনও সদুত্তর পাওয়া যায় না।
তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে শুধু "ডাবিং মিসটেক" বলে কতটি হলুদ সাংবাদিকতার সাফাই দেয়া হয়েছে জানি না! সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার যুক্তি দিয়ে যারা আল-জাজিরার পক্ষে বলেন, তারা কখনোই জবাব দিতে পারবেন না, আল-জাজিরা কেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নারীদের যৌন দাসীতে পরিণত করা সমর্থন করেছে। কেউ জবাব দিতে পারেন নি, লন্ডন ব্রিজে হামলাকারীর মা কেন তার সন্তানের উগ্রবাদী হওয়ার জন্য আল জাজিরাকে অভিযুক্ত করেছেন!
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের হিসেবে ধারণা করে যারা আল-জাজিরার খ্যাতিতে ভূমিকা রাখেন, তারাও আল-জাজিরার বিরুদ্ধে নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতা, জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা, ধর্মীয় উস্কানি ও হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ আনেন। দর্শক হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শাখাই বন্ধ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দর্শকরা হয়তো আল জাজিরাকে বয়কট করেছেন। মিশর, সিরিয়া, বার্লিন ও যুক্তরাষ্ট্রে সিওসহ অনেক সাংবাদিকরা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এমন সচেতনতা যে সর্বত্র দেখা যায় না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্বে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির জনক বলা হয় মুসলিম ব্রাদারহুডকে। আর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনের অলিখিত মুখপত্র আল-জাজিরা। ব্রাদারহুড ও আল কায়েদার সঙ্গে হামাস ও হিজবুল্লাহসহ বিশ্বের অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্পর্ক বলা যায় ওপেন সিক্রেট।
বাংলাদেশে আল জাজিরা তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না- এমন ধারণা করা সঠিক হবে না। হলুদ সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে যে গণমাধ্যমের নাম জড়িত, যে গণমাধ্যম একটি উগ্র রাজনৈতিক মতবাদের প্রতিনিধিত্ব করে, তা শুধু নিষিদ্ধ করলেই ঝুঁকি কমবে না। নিরাপত্তার স্বার্থেই আল জাজিরা সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : কলামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।abdullah.harun@live.com
এইচআর/পিআর