হঠাৎ করেই বাংলাদেশের মানুষের সামনে প্রশ্ন, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের সবচেয়ে সক্রিয়, সতেজ মাধ্যম, টেলিভিশন বাঁচবেতো? দেশের ৩২ টি চ্যানেলের প্রায় ১৬ হাজার কর্মী আজ অন্ধকার দেখছে। অনলাইনের বিকাশ ও বিস্তার, ডিজিটাল প্লাটফর্মে লাইভসহ ভিডিও কনটেন্ট, দেশের বিজ্ঞাপন পাচার হয়ে যাওয়া, হ্রাস পাওয়া, কেবল অপারেশন থেকে কোন অর্থ না আসাসহ নানাবিধ আঘাতে প্রমাদ গুণছে বাংলাদেশের টেলিভিশন খাত।
Advertisement
একসময় যা ছিল তারুণ্যের কাছে স্বপ্নের ভুবন, সেই টেলিভিশন এখন আর কারো জন্য ক্যারিয়ার নয়। প্রায় প্রতিদিনই অপ্রত্যাশিতভাবে কর্মহীন হয়ে যাচ্ছেন অনেকে, তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও কেউ যেন দেখার নেই। টেলিভিশন এখন কাউকে চাকরি দেয় না, বরং পূর্ণ বেকার তৈরি করছে -কোন কোন চ্যানেল আর্থিক ক্ষতির দোহাই দিয়ে, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে শুধুমাত্র একটি নোটিশ দিয়ে বার্তা কক্ষ গুটিয়ে ফেলছে, কোন আগাম ঘোষণা ছাড়া সাংবাদিক ও কর্মীছাটাই করছে।
আছে ছদ্ম বেকারও। যেমন- চাকরি আছে, বেতন নাই– কোন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ মাসের পর মাস সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীদের বেতন দিচ্ছে না এবং কোন কোন চ্যানেলে বেতন কমিয়ে দিচ্ছে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেতন দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সাফল্য একটি বিশেষ শর্ত। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এখন কোন কর্মসংস্থান নেই, তারা শুধু জনবল শুধু কমাচ্ছে।
সত্যি বলতে কি চ্যানেলে কাজ করার অর্থ এখন জীবনে বেপরোয়া ঝুঁকি নেয়া। দুই দশক হয়ে গেলে তবুও বেসরকারি টেলিভিশন খাত শিল্পে পরিণত হতে পারেনি। হাজার কোটি টাকার লগ্নি, হাজার হাজার পেশাজীবীর শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ। কিন্তু রুটি রুজির নিশ্চয়তাহীন এক পেশায় তবুও নাম লিখিয়ে চলেছে ঝাঁক ঝাঁক তরুণ তরুণী।
Advertisement
কেন এমন হল? অনেক কারণ আছে। এদেশের টেলিভিশনের একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। অথচ চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও বিজ্ঞাপন কমছে, চলছে বিজ্ঞাপনের দরপতন। আছে ডিজিটাল প্লাটফর্মের আগ্রাসন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণটি হল মধ্যস্বত্বভোগী একদল অসৎ ব্যক্তির মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন চলে যাওয়া। বড় বড় কোম্পানির বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এসব বিজ্ঞাপন দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় বড় আর্থিক ক্ষতিতে আজ আজ দেশীয় চ্যানেলগুলো।
বাংলাদেশে ভারতের বহু সংখ্যক পে-চ্যানেল এবং বেশ কিছু ফ্রি চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচারের নামে শত শত কোটি টাকা মূলত চলে যাচ্ছে ভারতে। ফলে – আমাদের চ্যানেলের কনটেন্টের মান নিম্নগামী, আমাদের চ্যানেলগুলোর দর্শক কমছে আর বেকার হচ্ছেন আমাদের কর্মীরা। অনেকেই বাংলাদেশের টেলিভিশনের কনটেন্টের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। সেই প্রশ্ন আমলে নিয়েই বলতে হচ্ছে, প্রায় বিনে পয়সায় কনটেন্ট বানিয়ে কি দাঁড়ানো যায় বিদেশি চ্যানেলের সামনে?
একটি দেশের টেলিভিশন মানে তার দেশের সংস্কৃতির বাহন, যা কখনো কোন বিদেশি চ্যানেল হতে পারে না। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভটির উপর নির্ভর করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং সর্বোপরি, সামাজিক দায়বদ্ধতা৷ সংকটের তীব্রতা টেলিভিশন ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বেশি।
বিদেশি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। আজ আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করতে হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশে এগুলো কী অবদান রাখছে? গত দুই যুগে এদেশে টেলিভিশন একটি বিকাশের জায়গায় এসেছে। এই খাতে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতা কোথায়? বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতায় সরকারের সাহায্য কোথায়?
Advertisement
টেলিভিশন মালিক, কর্মী, বিজ্ঞাপন এজেন্সিসহ নানাস্তর থেকে দাবি উঠার পর গত ১ এপ্রিল সরকার উদ্যমী হয়ে বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছে। নোটিশ পেয়েই একজন পরিবেশক দেশে ভারতীয় জি গ্রুপের চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়। অথচ সরকরের নোটিশে উল্লেখ ছিল ২০০৬ সালের ক্যাবল অপারেটর আইনে ১৯ এর ১৩ ধারা যেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারিত হবে ক্লিন ফিডে, অর্থাৎ কোন প্রকার বিজ্ঞাপন ছাড়া।
১৩ বছর ধরে এই আইন বর্তমান, অথচ আজ এত পরে এসেও আইনের বাস্তবায়ন করতে এসে পারা যায় না। ঔদ্ধত্য এ পর্যায়ে যে সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে বিজ্ঞাপন বন্ধ না করে সরাসরি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে উসকানি দেয়ার চেষ্টা হয়।
বাংলাদেশের কোন চ্যানেল যুক্তরাষ্ট্রে ডাউনলিঙ্ক করে প্রচার করা হলে, সেখানে শুধু প্রচারিত অনুষ্ঠান কিংবা সংবাদ দেখানো হয়। এর মাঝে বাংলাদেশি কোন বিজ্ঞাপন থাকলে তা বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারে করতে হয়। একই রীতি যুক্তরাজ্যেও। আর ভারতে তো বাংলাদেশি চ্যানেল প্রচারের সুযোগই নেই। চালাতে হলে ৫ কোটি টাকা দিতে হবে। সারা দুনিয়ায় এক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রীয় নীতি ও জাতীয়তাবোধ বাংলাদেশে তা মানেন না বিদেশে চ্যানেলের পরিবেশক ও কিছু ক্যাবল নেটওয়ার্কের সিন্ডিকেট। তারা বছরের পর বছর বিদেশী চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন চালানোর সুযোগ দিচ্ছেন।
আবার সেই চ্যানেল গুলোর বিদেশী বিজ্ঞাপন বাদ না দিয়েই ডাউন লিঙ্ক করছেন। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশি টিভি চ্যানেলগুলো। এভাবে দেশের প্রায় ৫ শত কোটি টাকা বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন পরিবেশক ও কেবল নেটওয়ার্ক সিন্ডিকেট। নিজেরাও পকেটে ভরছেন মোটা অংকের টাকা। আর এতে সাধারণ দর্শক ও সম্প্রচার কর্মীরা শুধুই ঠকছেন।
এই অবস্থায় সরকার দেশের আর্থিক স্বার্থ ও টেলিভিশন শিল্পের কথা বিবেচনা করে বিদেশি চ্যানেল ডাউনলিঙ্ক করে প্রচারে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিয়েছে। বলেছে, বিদেশী চ্যানেল প্রচারের সময় যে বিজ্ঞাপন থাকে তা বাদ দিয়ে প্রচার করতে হবে। চ্যানেল বন্ধ করতে বলেনি। এই দাবি ছিলো টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন- অ্যাটকো ও সম্প্রচার সংবাদ কর্মীদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসির।
সে অনুযায়ী তথ্য মন্ত্রণালয় কয়েক মাস আগে থেকেই বিদেশী চ্যানেলের পরিবেশক ও বিভিন্ন ক্যাবল নেটওয়ার্ক সংস্থার মালিকদের সতর্ক করেছে। এজন্য সময় বেঁধে দিয়েছিলো ১ এপ্রিল পর্যন্ত। তাই নির্দেশনা না মানায় দুটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করেছে। এ অবস্থায় প্রকৃত নির্দেশনা না মেনে পরিবেশক ও কিছু ক্যাবল নেটওয়ার্ক মালিকদের সিন্ডিকেট সরকারকে জিম্মি করতে বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় জি গ্রুপের চ্যানেলেই বন্ধ করে রেখেছে।
এতে করে ভুল বার্তা গেছে দর্শকদের কাছে। সরকারের ভালো একটি সিদ্ধান্ত আজ বিনা কারণে প্রশ্নের মুখে। প্রশ্ন হলো তারা কি এভাবে চাপ সৃষ্টি করে জিম্মি করতে চাইছেন? এবং সদম্ভে বলছেন, তাদের মতো করে না চললে বাংলাদেশি কোন চ্যানেলই তারা চালাবেন না?
আমরা কী চাই বাংলাদেশে কোন টিভি চ্যানেল থাকবে না? নিশ্চয়ই চাই না। যদি তাই হয় তাহলে আমরা সেই অনিয়মে বুঝে না বুঝে আর হাওয়া না দেই। অথচ আমরা কিছু মানুষের এই অনিয়মকে জায়েজ করতে নানা দোষারোপ করছি। বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছি।
মান ভালো না খারাপ এই প্রশ্ন আছে। সবাই তা স্বীকারও করে। কিন্তু এর সাথে বিদেশী চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপন আইন মেনে প্রচারের বা বাদ দেয়ার নির্দেশনার কী কোন বিরোধ আছে? নির্দেশনা মেনে প্রচার করলে বরং রাজস্ব পায় বাংলাদেশ। এতে প্রতিযোগিতাও থাকে? আর বিজ্ঞাপনের অর্থ যদি দেশেই থাকে, তাহলে দেশি টিভি চ্যানেলের সক্ষমতা বাড়ার সুযোগও থাকে।
সারাবিশ্বে যেখানেই বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে, তা হচ্ছে সব ধরনের বিজ্ঞাপন ফেলে দিয়ে এবং আমাদের আইনটিতেও তাই আছে। দেখার বিষয় সরকার কতটা শক্ত অবস্থানে থাকতে পারে। কারণ আজ বাংলাদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি জগতে বাঁচা মরার প্রশ্ন এটি।
সরকার ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে পারে। কারণ এখান থেকে সরকার কোন রাজস্ব পায় না। কেবল অপারেটররা এইসব চ্যানেলের সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে গ্রাহকদের কাছে থেকে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা কোটি টাকা আয় করে, অথচ চ্যানেলগুলো এক টাকা পায় না। এর ভাগ চ্যানেলগুলোকে দেয়ার ব্যবস্থা সরকারই করতে পারে। এতে কনটেন্টের মানেও উন্নতি হতো।
গণতন্ত্রকে সংহত করতে গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের উদ্যোগ আজ বড় প্রয়োজন। টেলিভাইজড নিউজ গণমাধ্যমের অগ্রণী স্বর হিসেবে সমাজ আর রাষ্ট্রের যোগসূত্রের কাজ করে। আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হল টেলিভিশন। তথ্য-যুক্তির বিন্যাসে সমাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনই এর প্রাথমিক কাজ। সমাজের নানা সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরছে সে। সরকার-পরিপন্থী কোন দায়িত্ব পালন তার কাজ না, কিন্তু সময়বিশেষে কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরতে হয় তাকেই। আবার সরকারি পরিকল্পনা, কর্মকাণ্ডের বয়ানও সর্বজনের কাছে নিয়ে যাওয়া টেলিভিশনের দায়।
সমাজ বা রাষ্ট্রের অক্ষমতা আর দুর্বলতা ঢেকে দিতে পারে ইমেজ দুনিয়া। সেই ইমেজ দুনিয়াই টেলিভিশন সংবাদ। এই খাতে আছে একদল অদম্য, সফল বা নিবেদিত কর্মীবাহিনী। আগামীতে রাষ্ট্র ও সমাজের যে নয়া সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে সেখানে এরাই আগ্রাসী জনপ্রতিনিধি। দ্রুত সম্প্রচার কমিশন হোক, সম্প্রচার কর্মীদের আলাদা বেতন কাঠামো নির্ধারিত হোক। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভাজনরেখা বড় করতে না চাইলে টেলিভিশনকে বাঁচাতেই হবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জি টিভি।
এইচআর/আরআইপি