>> ২১তলা থেকে পড়েও প্রাণে বেঁচে যান রিজওয়ান আহমেদ >> চার ঘণ্টা ১১তলায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন সবুর খান
Advertisement
‘আগুনের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। বার বার দম আটকে যাচ্ছিল। প্রাণ বাঁচাতে ২১তলা থেকে কার্নিশ বেয়ে নিচে নামার ঝুঁকি নেই। এয়ারকন্ডিশন সংলগ্ন কার্নিশ বেয়ে ঝুলে একটু নিচে নেমে আসি। পাশেই লোহার পাইপ, সেটি বেয়ে নিচে নামতে পারব- ভেবে দু’হাত দিয়ে সেটি জড়িয়ে ধরি।’
‘কিন্তু আগুনের তাপে তীব্র গরম হয়ে যাওয়া পাইপে হাত দেয়ামাত্র প্রচণ্ড তাপ অনুভব করি। সহ্য করতে না পেরে হাত ফসকে পড়ে যাই। ধোঁয়া আর আগুনের মধ্য দিয়ে তীব্র গতিতে নিচে পড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো শরীরটা কোনো কিছুর সঙ্গে লেগে তীব্র ঝাঁকুনি খেল। তারপর আবারও নিচে পড়ে যাই।’
আরও পড়ুন >> শত চেষ্টাতেও বাঁচতে দেয়নি ধোঁয়া
Advertisement
‘এই ধর ধর, এখনও বেঁচে আছে, অ্যাম্বুলেন্সে তাড়াতাড়ি কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠা। অনেক লোকের চিৎকার-চেচামেচির শব্দ পাচ্ছিলাম। এটুকু বুঝেছিলাম, তখনও মরিনি, বেঁচে আছি। এরপর আর কিছুই মনে নেই।’
জাগো নিউজের কাছে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ভবনের চতুর্থ তলার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন রিজওয়ান আহমেদ (৩৫)। গত ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণে বাঁচতে রিজওয়ান আহমেদ ২১তলা ভবন থেকে নিচে নামতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে যান। মারাত্মক আহত হন তিনি।
ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের ২১তলার কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন রিজওয়ান আহমেদ।
আরও পড়ুন >> বিয়ের ৮ মাসেই আগুনে মিথির সব শেষ
Advertisement
মঙ্গলবার দুপুরে আইসিইউ’র বেডে শুয়ে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা রিজওয়ান আহমেদ সেই ভয়াল দিনের কথা বলতে গিয়ে বার বার কেঁপে উঠছিলেন। প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় ক্ষিণকণ্ঠে মহান আল্লাহতাআলা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরিবার-পরিজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ঢামেক আইসিইউ’র বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোজাফফর হোসেন জানান, ২১তলা থেকে পড়ে গেলেও তিনি সরাসরি নিচে পড়েননি। ২১তলার পর তৃতীয় তলায় এসে মোটা ডিশ ও ইলেকট্রিক তারের ওপর আছড়ে পড়েন। এরপর নিচে পড়েন।
তিনি বলেন, মানুষের শরীরের ওপরের অংশ ভারী হওয়ায় অনেক ওপর থেকে পড়লে স্বাভাবিক কারণে মাথা নিচের দিকে থাকে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনি তিনতলার তারের ওপর পড়েন। এ কারণে তার পড়ার গতি বাধাগ্রস্ত হয়। মাথা নিচের দিকে পড়েনি। পা নিচের দিকে পড়ে গুরুতর আহত হন। তার বাম পা, ডান হাত ও দুই কলারবোন ভেঙে যায়। আগুনের মধ্য দিয়ে পড়ায় তার চেহারাও খানিকটা ঝলসে যায়।
আরও পড়ুন >> ‘আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি, ক্ষমা করে দিও বাবা’
‘প্রথমদিকে তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও বর্তমানে তিনি অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত’- বলেন এ চিকিৎসক।
চার ঘণ্টা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আবদুস সবুর খান
অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনায় দীর্ঘ চার ঘণ্টা ১১তলায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের মাধ্যমে উদ্ধার পান আবদুস সবুর খান। তিনিও আইসিইউ’র বেডে শুয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন জাগো নিউজের কাছে।
এফআর টাওয়ারের ১১তলার একটি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেইট ফরোয়ার্ড কোম্পানি- ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবদুস সবুর খান। ওই অফিসে সেদিন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ জন স্টাফ ছিলেন। ওই ঘটনায় পাঁচ সহকর্মীকে হারান তিনি। আলাপকালে আবদুস সবুর খান বলেন, ‘আগুন ও ধোঁয়ার সঙ্গে দীর্ঘ চার ঘণ্টা লড়াই করে শেষ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করলে প্রাণে বেঁচে যাই। আট হাজার বর্গফুট আয়তনের অফিসটিতে অভ্যর্থনা কেন্দ্র, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষ, কনফারেন্স হল ও নামাজের কক্ষ ছাড়া বাকি জায়গা খোলামেলা ছিল।’
আরও পড়ুন >> ১৮ তলায় উঠেও বাঁচতে পারেননি বৃষ্টি
‘আটতলায় লাগা আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে আমরা দক্ষিণ ও উত্তর পাশের সব গ্লাস ভেঙে দেই। সে সময় ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একটু অক্সিজেন যেখানে পেয়েছেন, সবাই সেখানেই ছুটে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পরপরই স্ত্রী রাবেয়াকে ফোন দেই। জানাই, আমাদের অফিসের ভবনে আগুন লেগেছে। আবার কথা বলতে পারব কিনা- জানি না। দোয়া করো, বলে ফোন কেটে দেই।’
‘ভাবতেই পারিনি বেঁচে যাব। মনে হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাচ্ছি।’
‘কিছুক্ষণ পরপর জানালার পাশে এসে হাত নাড়িয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য আকুতি জানাচ্ছিলাম। ধোঁয়ায় বার বার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাইরে থেকে লোকজন জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে নিষেধ করছিল। তারা বার বার আশ্বাস দিয়ে বলছিল, তোমরা ওইখানেই থাক। তোমাদের উদ্ধার করা হবে। তারা আশ্বাস দিলেও বার বার মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারব কি?’
আরও পড়ুন >> মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চেয়ারেই বসেছিলেন পঙ্গু মঞ্জুর
তিনি বলেন, নিচে ১০তলার আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা তখন আমাদের উদ্ধার করতে পারেনি। পরে আমিসহ ২০ জনকে উদ্ধার করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনে উঠে অচেতন হয়ে পড়ি। ধোঁয়ায় আমার শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইসিইউর বিভাগীয় প্রধান মোজাফফর হোসেন বলেন, আবদুস সবুরকে আজকালের মধ্যে কেবিনে স্থানান্তর করা হবে। শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ইনচার্জ সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আকতার জানান, ২৮ মার্চ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ১৩০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ওই ঘটনায় মোট ২৬ জনের মৃত্যু হয়। বর্তমানে নয়জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এমইউ/এমএআর/আরআইপি