জাতীয়

যেসব যুক্তিতে তাসভির-ফারুকের জামিন আবেদন

বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ভবনের বর্ধিত অংশের মালিক তাসভির উল ইসলাম (৬৬) ও ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুকের (৭৫) বিরুদ্ধে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

Advertisement

মামলায় তাসভির উল ইসলাম ও এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর জোগসাজশে মানুষের জানমালের ক্ষতি, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কার্যকলাপের ফলে অপরাধজনক অগ্নিকাণ্ডে মানুষের প্রাণহানি, মারাত্মক জখমসহ সম্পদের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়।

মামলার অপর আসামি রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন।

গত বৃহস্পতিবার বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও হাসপাতালে একজন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন অন্তত ৭৩ জন।

Advertisement

রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীর আদালতে উভয়পক্ষের রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে তাসভির উল ইসলাম ও এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

আদালতে জমির মালিক ফারুকের পক্ষে রিমান্ড শুনানিতে তার জামিন আবেদন করা হয়। ফারুকের আইনজীবী ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান খান রচি শুনানিতে আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ফারুক বয়স্ক মানুষ। তিনি ক্যান্সারের রোগী। তার কাগজগুলো ডিবির অফিসে দেয়া হয়েছিল। সেখানে সেগুলো আটকে রাখা হয়েছে। তাই আদালতে দিতে পারছি না।’

‘যদি আপনি তাকে (ফারুক) রিমান্ডে দেন তাহলে তারা (ডিবি পুলিশ) তাকে টর্চার করে মেরে ফেলবে। বিজ্ঞ আদালতের কাছে আমার নিবেদন, আপনি মানবিক দিক বিবেচনা করে অন্তত জেলখানায় দুদিন, পাঁচদিন, ১০ দিন জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ প্রদান করুন।’

তার পক্ষের অপর আইনজীবী ঢাকা বারের সভাপতি গাজী শাহ্ আলম শুনানিতে বলেন, ‘উনি (ফারুক) জমির মালিক, জমি বুঝিয়ে দেয়ার পর তার আর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। তার শারীরিক অবস্থা, বয়স বিবেচনায় দয়া করে তাকে জামিন প্রদান করেন। প্রয়োজনে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। পুলিশের হাতে দেয়া মানে আননেসেসারি একটা টর্চারের মধ্যে ঠেলে দেয়া।’

Advertisement

আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন বলেন, ‘একটা জমি যখন ডেভেলপারকে দেয়া হয়, তখন চুক্তি সম্পাদন হয়। ফারুক ভবনটি বুঝিয়ে দেন। বর্তমানে তিনি একা ভবনের মালিক নন। যারা ১০০ স্কয়ার ফুটের দোকান নিয়েছেন তারাও ওই জমির মালিক। তাই একা ফারুক সাহেবের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না, মাননীয় আদালত। আরেকটা বিষয় আদালতের কাছে বলতে চাই, ১৮ তলার নকশা অনুমোদনের পর ভবনটি যে ২৩ তলা করা হয়েছে, অর্থাৎ পাঁচটা তলার মধ্যে একটা তলা তোলার জন্যও যদি আমার কোনো স্বাক্ষর থাকে তাহলে আমি বলব, আমাকে রিমান্ডে দেন। আমাদের কোনো সমর্থন ছিল না। আগুন লাগার পেছনে ভবনের ম্যানেজিং কমিটিতে যারা আছেন, ভবনটা যারা দাঁড় করিয়েছেন, তাদেরও দায় আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্যার, উনার ৭৩ বছর বয়স। এই বলে আমি এক্সট্রা কোনো ফায়দা নিতে চাই না। তবে তাকে যদি রিমান্ডে নেয়া হয়, সেখানে মানসিক টর্চার আর হ্যারাজমেন্ট ছাড়া কিছুই করা হবে না। আমাকে যা জিগাইতে চায়, যতদিন যতবার জিগাইতে চায় আমারে জিগাক, আমার কোনো আপত্তি নাই। সব বইলা দিমু।’

অভিযুক্ত ফারুকের পক্ষে শুনানিতে তার পুত্রবধূ, মডেল ও আইনজীবী জান্নাতুলও অংশ নেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও এফআর টাওয়ারে অফিস করি। উনি ভূমির মালিক। কিন্তু উনি ভবন ব্যবস্থাপনা করেন না। ভবন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। উনি ওই অ্যাসোসিয়েশনে নেই। তারাই বলবে, তারা টাওয়ারটাকে কেমন রেখেছে? ওই ভবনের লিফটও ঠিক ছিল না। ফারুক নিজে টাকা খরচ করে সবার কথা চিন্তা করে তা ঠিক করিয়েছেন। ২০০৮ সালে একটি আগুন লেগেছিল। তখন তিনি গুলশান থানাকে অবগত করেছিলেন যে, ভবনে যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই।’

‘১১ বছর পর একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। পুলিশ তাদের আবেদনে বলেছে, অন্য আসামি ধরার জন্য ফারুকের রিমান্ড প্রয়োজন। আমার কথা, ফারুক যখন ডেভেলপারের কাছে জমি দিয়ে দেয়, এরপর ডেভেলপারের কাছ থেকে সেটি টেকওভার করে একটা অ্যাসোসিয়েশন। আমি বলব, দুজনই বয়স্ক মানুষ, দুজনকেই আমি চিনি। এ বয়সে এসে, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে… যদি রিমান্ডে নেয়া হয় তাহলে কি টাওয়ার…. আর কী ভোগ করবে? জীবন নিয়েই তো টানাটানি, স্যার।’

এ প্যানেলের আপর আইনজীবী বলেন, ‘গতকাল রাতে ফারুকের ইসিজি করা হয়েছে। উনার জীবনটাই ঝুঁকিপূর্ণ। উনি যদি না বাঁচেন, তাহলে বিচারটা করবেন কার? উনি নতুন করে অসুস্থ নয়, আগে থেকেই অসুস্থ। একবার উনার চেহারাটা দেখেন, স্যার। শরীরটা ফুলে গেছে উনার।’

শুনানিতে ভবনের বর্ধিত অংশের মালিক তাসভির উল ইসলামের আইনজীবী ছিলেন এহসানুল হোক সামাজি। তিনিও তার মক্কেলের রিমান্ড আবেদন নাকচ করে জামিনের আবেদন করেন। জামিনের রেফারেন্স হিসেবে তিনি আদালতকে বলেন, ‘২০১৭ সালে লন্ডনে তাসভির উল ইসলামের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। সেখানে তাকে টাইম টু টাইম (নিয়মিত) চেকআপে যেতে হয়। এছাড়া তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। প্লিজ তার রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করুন।’

তবে আদালত দুজনের বিরুদ্ধেই সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রোববার বেলা আড়াইটার দিকে তাদের দুজনকে আদালতে হাজির করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় দুই আসামিই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাদের রিমান্ড শুনানি সিএমএম কোর্টের অষ্টম তলায় অনুষ্ঠিত হয়। তবে ডিবির কর্মকর্তারা শুনানি শেষে তাদের লিফটে নিচে নামাতে চাইলে তারা হেঁটেই নামেন। সিঁড়িতে নামতে নামতে তাসভির উল তার ম্যানেজারের সঙ্গে ভবনের বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক।

ম্যানেজার তাসভিরকে জানান, পুলিশ ওই ভবনের প্রতিটি অফিসে দুজন প্রতিনিধিকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। তাসভিরুল এ সময় তাকে সবকিছু দেখে রাখার নির্দেশ দেন।

গত বৃহস্পতিবার এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনে ঘটনায় গতকাল শনিবার (৩০ মার্চ) বনানী থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যু সংঘটনের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে তাসভির উল ইসলাম, জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক (৬৫) ও রূপায়নের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

শনিবার মধ্যরাতে বারিধারা থেকে তাসভির উল ইসলাম এবং ফারুককে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে রূপায়নের চেয়ারম্যানকে একাধিক অভিযানে পাওয়া যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি দেশত্যাগ করতে পারেন।

এআর/জেএ/এএইচ/এমএআর/পিআর