বনানীর এফআর টাওয়ারটি একাধিকবার পরিদর্শন করে এর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটির বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এজন্য কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে পরপর দু'বার নোটিশ করেও কাজ হয়নি। ভবনের ফায়ার সেফটি ইস্যুতে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
Advertisement
বনানীর ফারুক-রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভবনমালিকদের গাফিলতির প্রমাণ স্পষ্ট বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা কিংবা সংকীর্ণ জরুরি বহির্গমন পথের প্রমাণও এর আগে পাওয়া যায়। এছাড়া ১৮ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করার কারণ হিসেবে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেনি ভবন কর্তৃপক্ষ।
এজন্য ডেভলপার কোম্পানির গাফিলতি ও ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে দায়ী করছেন মালিকপক্ষ। মালিকপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। তিনি ১৯৯৫ সালে ভবনের নকশার জন্য রাজউকে আবেদন করেন। অনুমোদন পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রূপায়ন গ্রুপকে ভবন বানানোর জন্য জমি দেয়া হয়।
২০০৫ সালে কাজ শুরু হওয়া ভবনটি চালু হয় ২০০৭ সালে। তখন থেকে ভবনের প্রায় অর্ধেক অংশের মালিকানা ফারুকের, বাকি অর্ধেক রূপায়ন গ্রুপের। ফারুক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও এফআর টাওয়ারের তৃতীয় তলায় কনভেনশন সেন্টার ও ১৮ তলায় অফিস স্পেস নামে একটি বিজনেস সেন্টার রয়েছে। ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাসবিরুল ইসলামের মাধ্যমে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। ফারুকের পক্ষ থেকে তার ম্যানেজার কামাল হোসেন ভবনটি দেখাশোনা করতেন।
Advertisement
ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভবনটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। এ বিষয়ে তাদেরকে একাধিকবার নোটিশ করা হলেও তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিডি) দেবাশিষ বর্ধন জানান, এর আগে আমরা এফআর টাওয়ারটি একাধিকবার পরিদর্শন করি। ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিসহ সেগুলো সমাধানে কিছু সুপারিশও করা হয়। এ বিষয়ে তাদের দুবার নোটিশও করা হয়। কিন্তু ভবন কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে ভবনটির ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবনে অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। ফায়ার স্টিংগুইসার থাকলেও আগুনের পর সেগুলো খোলা হয়নি। ইমার্জেন্সি এক্সিট পয়েন্ট রয়েছে এবং সেটা সবসময় খোলা থাকে।
ফায়ার সার্ভিসের নোটিশ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন ধরনের নোটিশের বিষয়ে আমার জানা নেই। অনুমোদনের বাইরে উপরের পাঁচ তলা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজার কামাল বলেন, ১৮ তলার অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও ২৩ তলা করার বিষয়ে আমাদের আপত্তি ছিল। কিন্তু ভবন পরিচালনা সোসাইটির সভাপতি তাসবিরুল ইসলাম বলেন যে, সমস্যা নাই। তার ইচ্ছাতে এটি নকশার বাইরে পাঁচ তলা বাড়ানো হয়।
শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ভবনটির ১৮ তলার অনুমোদন ছিল, কিন্তু এটি কীভাবে ২৩ তলা হলো! এর অনুমোদনের সময় রাজউক চেয়ারম্যান কে ছিলেন সেটিও খুঁজে দেখা হচ্ছে। এ কাজে যাদেরই অবহেলা রয়েছে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Advertisement
গতকাল বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। যেগুলো ছিল সেগুলো ইউজঅ্যাবল ছিল না। এমনকি যে পাইপটি আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার হয় সেটিও পুড়ে যায়। ফলে তাৎক্ষনিক ফায়ার ফাইটিং করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। ভবনমালিক ফারুকও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, এফআর টাওয়ারের মালিকের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভুক্তভোগী, নিহতদের স্বজনরা মামলা করবেন। তারা যদি না করেন তবে রাষ্ট্রপক্ষ অর্থাৎ পুলিশ বাদী মামলা হবে। যেসব ধারায় মামলা করলে নন বেইলেবল (অজামিনযোগ্য) হবে সেসব ধারা পর্যালোচনা করে মামলা করা হবে।
আইজিপি বলেন, ইতোমধ্যে পুলিশ ভবনের মালিককে শনাক্ত করেছে। মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। রাজউক ও গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বলেছেন, ইমারত কোড অমান্য করে ভবনটি ১৮ তলার বিপরীতে ২২ তলা করা হয়েছে। সুতরাং সেটা আইনের ব্যত্যয়। এখানে যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকের জীবনের মূল্য ও বাঁচার অধিকার রয়েছে। সেটার ব্যত্যয় ঘটেছে। এ ব্যাপারে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের অবস্থান। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে এ ভবনে আগুন লাগে। এতে ২৫ জন নিহত ও ৭৩ জন আহত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জেইউ/এমএআর/পিআর