আন্তর্জাতিক

এই শতাব্দীতে মানবজাতি বিলুপ্ত হবে?

ডাইনোসর যেভাবে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মানবজাতিও ঠিক একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে! জলবায়ুর পরিবর্তন, পরমাণু যুদ্ধ, মহামারী কিংবা মহাকাশ থেকে ছুটে আসা অ্যাস্টরয়েড বা গ্রহাণুর আঘাতসহ অনেক ধরনের লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর যে কোনো একটিই পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।

Advertisement

দার্শনিক ডেভিড এডমন্ডস এসব নিয়ে কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে, যারা ঠিক এই প্রশ্নটিরই উত্তর খুঁজেছেন তাদের সারাজীবনের কাজ দিয়ে। এই শতাব্দীর পর পৃথিবীতে কি আর মানুষ টিকে থাকবে?

অস্তিত্বের জন্য হুমকি কোনটি

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিউচার অব হিউম্যানিটি ইনস্টিটিউটের’ গবেষক অ্যান্ডার্স স্যান্ডবার্গ বলছেন, ‘‘এটি হচ্ছে এমন এক ধরনের ঝুঁকি, যা আসলে মানবজাতির জন্য হুমকি এবং যার কারণে পৃথিবীতে আমাদের কাহিনি শেষ হয়ে যেতে পারে এখানেই।’’

Advertisement

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল আমরা খুব নিরাপদ এক গ্রহে বাস করি। কিন্তু এই ধারণা আর সত্য নয়। মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করছে এমন ঝুঁকি একটি নয়, অনেকগুলো। যেমন:

পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত

মহাকাশ থেকে ছুটে আসা পাথরখণ্ডের আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে এমন আশংকা গত শতকের আশির দশকের আগ পর্যন্ত মোটেই আমলে নেয়া হত না। কিন্তু ১৯৮০ সালে এই ধারণা পাল্টে দিলেন দুই বিজ্ঞানী। লুইজ আলভারেজ এবং তার ছেলে ওয়াল্টার আলভারেজ, তারা দু’জনেই ছিলেন বিজ্ঞানী।

এই দু’জনের প্রকাশিত গবেষণায় দাবি করা হয়, ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল মহাকাশ থেকে ছুটে আসা এক গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানার পর। তাদের এই গবেষণাটি এখন বিজ্ঞানীদের এক আন্তর্জাতিক প্যানেল স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশেষ করে মেক্সিকোর ইউকাটান পেনিনসুলায় বিরাট এলাকাজুড়ে এক বিশাল বিশাল গর্ত বা ক্রেটার আবিষ্কৃত হওয়ার পর।

Advertisement

জলবায়ুর পরিবর্তন

গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হবে, এমন আশংকা অবশ্য খুবই কম বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে এর চেয়ে বেশি আশু বিপদ হিসেবে দেখছেন মানুষেরই তৈরি করা কিছু বিপদ। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, সম্পদের বিনাশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন।

জলবায়ুর পরিবর্তন যে আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে, এটা এখন সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক কারিন কুহলেম্যান এর চেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার দিকে।

কারিন কুহলেম্যান বলছেন, ‘অন্য অনেক কিছুর মতো যা মানবজাতির কবর রচনা করতে পারে, তার মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন আর মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার ব্যাপারটি পরস্পর সম্পর্কিত। যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানো না যায়, তাহলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানো যাবে না বলে মনে করেন তিনি।

 

জীববৈচিত্রের ধ্বংস

যেভাবে আমরা এই গ্রহে বাস করছি তা জীববৈচিত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, এই শতকের মাঝামাঝি নাগাদ সাগরে মাছ এতটাই কমে যাবে যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ ধরা আর লাভজনক হবে না। একই ঘটনা ঘটছে কীট-পতঙ্গের ক্ষেত্রে।

নীরবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক ধরনের কীট-পতঙ্গ। এর পরিণামে অনেক প্রজাতির পাখিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কারণ এই কীট-পতঙ্গ খেয়েই তার বাঁচে। জীববৈচিত্র ধ্বংসের পরিণাম কী দাঁড়াবে তা আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না, বলছেন কারিন কুহলেম্যান। কিন্তু এটা আঁচ করা যায় যে, এর ফল খুব ভালো হবে না।

বিশ্বব্যাপী মহামারী

ললিথা সুন্দরম কাজ করেন কেমব্রিজের ‘সেন্টার ফর এক্সিসটেনশিয়াল রিস্কে।’ মূলত জীবাণু বাহিত রোগব্যাধি মানবজাতির জন্য কী ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে, সেটা নিয়েই তারা গবেষণা করেন।

১৯১৮ সালে বিশ্বজুড়ে যে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র মহামারী দেখা দিয়েছিল, তাতে নাকি গোটা বিশ্বের অর্ধেক মানুষ কোনো না কোন সময় আক্রান্ত হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এই স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় পাঁচ হতে দশ কোটি মানুষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিপুল হারে যে অভিবাসন হয়েছিল সেটাকে এই মহামারীর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। তখন মানুষ ভ্রমণ করতো ট্রেনে বা নৌপথে। আর এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো রোগ ছড়াতে পারে অতিদ্রুত, কারণ এখন মানুষ বিমানে দিনেই পাড়ি দিতে পারে কয়েকটি মহাদেশ।

পরমাণু যুদ্ধ

একটা পরমাণু যুদ্ধ বেধে গেলে সেই যুদ্ধেই হয়তো পৃথিবীর সব মানুষ মারা যাবে না, কিন্তু এই যুদ্ধের পর যে বিকীরণ এবং প্রতিক্রিয়া হবে, তাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবজাতি।

গ্লোবাল ক্যাটাসট্রফিক রিস্ক ইনস্টিটিউটর সেথ বম বলছেন, ‘পরমাণু হামলায় জ্বলতে থাকা নগরী থেকে যে ছাই ছড়িয়ে পড়বে, তা আকাশে মেঘের স্তর পেরিয়ে স্ট্র্যাটোসফিয়ারে পৌঁছে যেতে পারে। কয়েক দশক ধরে হয়তো এই ছাই সেখানে থাকবে এবং তা সুর্যোলোক আটকে দিতে পারে।’

পরমাণু যুদ্ধের কারণে মানবজাতির বিলুপ্তি কয়েকটি ধাপে ঘটবে। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কাতেই ব্যাপক প্রাণহানি, এরপর অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং পরবর্তীতে পরিবেশগত বিপর্যয়।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে নানা দিক থেকে। স্বয়ংক্রিয় এলগরিদম দুর্ঘটনাবশত বিশ্বের শেয়ার বাজারে ধস নামিয়ে দিতে পারে। সেটি থেকে ঘটতে পারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। অথবা আমরা মেশিনের ওপর আমাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারি।

একটা দৃশ্যপটের কথা ভেবে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত, যেখানে ‘ডীপ ফেক’ ভিডিও ব্যবহার করা হতে পারে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের এমন ‘নকল’ ভিডিও তৈরি করে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব, যেখানে আপনি যা চান তাই তাদেরকে বলতে বা করতে দেখা যাবে।

কীভাবে এসব হুমকির মোকাবেলা করা সম্ভব-

এই নানা ধরনের হুমকি মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের মত। কিভাবে ভবিষ্যতের মেশিন মানুষের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছেন অ্যান্ডার্স স্যান্ডবার্গ।

মহামারীকে কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছেন অনেকে। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে আকাশে ধুলোর মেঘ তৈরির কথা বলছেন অনেকে। পরমাণু যুদ্ধের পর কেবল মাশরুমের ডায়েট খেয়ে বাঁচা যায় কিনা, সেটা নিয়েও চলছে নিরীক্ষা। তবে কারিন কুহলেম্যান মনে করেন, সবচেয়ে আগে দরকার জনসংখ্যা সীমিত রাখা।

‘আমাদের এই ধারণ ত্যাগ করতে হবে যে বেশি সংখ্যায় সন্তান নেয়া আমাদের অধিকার এবং আমরা যা চাই তাই ভোগ করতে পারি’, বলছেন তিনি। ‘‘যদি এই শতককেই আমরা মানবজাতির জন্য শেষ শতক বলে ধরে না নেই, তাহলে আমাদের এই হুমকিগুলো মোকাবেলার কথা গুরুত্বের সঙ্গেই ভাবতে হবে।’

এমআরএম/এমএস