খেলাধুলা

রাজ্জাকের স্মৃতিতে ১৮ বছর আগের সেই বিগ ম্যাচ!

বুধবার পড়ন্ত বিকেল থেকে একটা যন্ত্রনার কাঁটা বিধছে মনে। বার বার মনে হচ্ছে বাঁ-হাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে ৪০০ উইকেট শিকারী হলো, লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ দারুণ মাইলফলক স্পর্শ করলো; কিন্তু তাকে নিয়ে সে অর্থে তেমন কিছু লিখলাম না। তার এ অসামান্য অর্জন, কৃতিত্ব ও প্রাপ্তিতে অবশ্য মিডিয়ায় লেখালেখি হয়েছে। কয়েকটি ভাল লেখাও প্রকাশিত হয়েছে প্রিন্ট এবং অনলাইনে মিডিয়ায়।

Advertisement

কিন্তু আমি কিছু লিখিনি। কেন লিখিনি? তবে কি আমিও আর সবার মত উদীয়মান সূর্য্যের পুজারি? অস্তগামি সূর্য্যের কথা বেমালুম ভুলে থাকতে চাই? শুধু যাদের বৃহস্পতি তুঙ্গে তাদের কথাই ভাবি? যাদের সময় ভাল তাদের নিয়েই মেতে থাকি? আব্দুর রাজ্জাক যদি এখনো জাতীয় দলের হয়ে খেলতেন, তিনি যদি এখনো টিম বাংলাদেশের নিয়মিত সদস্য থাকতেন, তার স্পিন ঘূর্ণি যদি আগের মত এখনো টাইগারদের বোলিং ট্রাম্পকার্ড, কার্যকর অস্ত্র হিসেবে পরিগণিত হতো- তাহলে নির্ঘাত এ বাঁ-হাতি স্পিনারকে নিয়ে কিছু লিখার তাড়না বেশি থাকতো। মনের গহীনে বারবার এই কথাগুলিই নাড়া দিচ্ছিল।

আজ সকাল থেকেই মনে হলো, নাহ! সত্যিই তো আব্দুর রাজ্জাকের লিস্ট এ ক্রিকেটে ৪০০ উইকেট প্রাপ্তি নিয়ে একটা লেখা অবশ্যই দরকার। কি নিয়ে লিখবো? লেখার উপজীব্য বা কি হবে? সহযোগি অনলাইন ও পত্রিকায় তার পরিসংখ্যান নিয়ে একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে।

তাহলে আমি লিখবো? ভাবতে ভাবতে আবার আমার দেখা স্মৃতি বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো। হঠাৎ, মাথায় চলে আসলো, আরে আমি তো রাজের (রাজ্জাকের ডাক নাম) প্রিমিয়ার ক্রিকেটে প্রথম দিন খেলতে দেখেছি। তা নিয়েই লিখি। তাতে খানিক নতুনত্ব থাকবে। প্রজন্মের জন্য একটা নতুনত্বের খোরাকও হবে।

Advertisement

আসুন ফিরে যাই দেড়যুগ আগে। তারিখটা ঠিক মনে নেই। মাস নিয়েও আছে সংশয়। সম্ভবত নভেম্বর মাস। তবে সনটা ২০০১। সেই ১৮ বছর আগের স্মৃতিটা আরও ভাল করে ঝালাই করে নিতে বৃহস্পতিবার সকাল সকাল মুঠোফোনে কল দিলাম রাজ্জাককে। সৌজণ্যতা বিনিময়ের পর আসল কথাটি পাতলাম।

‘আচ্ছা যে লিস্ট এ’তে আপনি প্রথম বোলার হিসেবে ৪০০ উইকেট শিকারী হয়ে দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারি হলেন, সেই প্রিমিয়ার লিগে আপনার অভিষেক, যাত্রা শুরুর গল্পটা মনে আছে?’

বিনয়ী রাজ্জাকের আমতা আমতা জবাব, আসলে ঠিক মনে পড়ছে না। প্রতিপক্ষ আর দিনক্ষণ মনে নেই। দেড়যুগ আগের কথা। কেমন যেন আবছা আবছা লাগছে।’

‘আচ্ছা! আমি না হয় একটু তাল ধরিয়ে দেই, মনে করে দেখুন তো, প্রিমিয়ার লিগে আপনার প্রথম ম্যাচ কি মোহামেডানের বিপক্ষে, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে? প্রথম ম্যাচেই কি আপনি কি নান্নু ভাইয়ের (মোহামেডান তথা জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক) উইকেট পেয়েছিলেন?’

Advertisement

‘আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক মনে পড়েছে। ঢাকার প্রিমিয়ার লিগে ওটাা আমার প্রথম ম্যাচ ছিল কি না মনে করতে পারছি না, তবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মোহামেডানের বিপক্ষে যে প্রথম বিগ ম্যাচ খেলতে নেমেছিলাম, তা ঠিক মনে আছে।’

সেদিনের ১৮ বছর বয়সী রাজ্জাকের স্পিন খেলতে কষ্ট হচ্ছিল সে সময়ের তিন শীর্ষ তারকার অন্যতম দুইজন নান্নু ও বুলবুলের (আমিনুল ইসলাম)। রাজের বিনয়ী সংলাপ, না না, কষ্ট হচ্ছিল বলা যাবে না। উনারা দুজন তো গ্রেট। আমি তখন একেবারে আনকোরা তরুণ।

‘সে বছরই বিমানের মত বড় দলের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে শুরু করেছিলাম। তবে এটুকু পরিষ্কার মনে আছে, জীবনের প্রথম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তখনকার কাগজে কলমের এক নম্বর দল মোহামেডানের বিপক্ষে প্রথম বিগ ম্যাচ খেলতে নেমে ভাল বল করেছিলাম। মোহামেডানের ব্যাটিং লাইনআপ তখন দারুণ সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী। নান্নু ভাই আর বুলবুল ভাইয়ের মত বড় মাপের ব্যাটসম্যান, যারা দুজনই আবার স্পিনে মাস্টার। সমীহ আদায় করা বহুদুরে, দেশ ও বিদেশের অনেক ঝানু স্পিনারও তাদের বিপক্ষে বল করে সুবিধা করতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে আছে, আমি বোলিংয়ে আসার পর তাদের রান তোলার গতি কমে গিয়েছিল। যে নান্নু ভাই বাঁ-হাতি স্পিনারদের বলে স্কোয়ার লেগ আর মিড উইকেটের মাঝখান দিয়ে একটি কন্ট্রোল সুইপ খেলতেন, সেই মাস্টার ব্যাটসম্যানও আমার বলে সুইপ খেলতে গিয়ে টপ এইজে কট আউট হলেন। আর স্বাভাবিক ছন্দ-লয়ে খেলতে না পারা বুলবুল ভাইও শর্ট সিঙ্গেলস নিতে গিয়ে রান আউট হলেন। সেটাও আমার বলেই। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচ কিনা মনে নেই, তবে ২০০১ সালের সম্ভবত নভেম্বর মাসে ফারুক ভাইয়ের ক্যাপ্টেন্সিতে সেটা যে আমার প্রিমিয়ার লিগে প্রথম বিগ ম্যাচ ছিল, তাতে সন্দেহ নেই’- এক নাগাড়ে বলে থামলেন রাজ্জাক।

এরপরক্ষণেই আবার বললেন, ‘প্রিমিয়ার লিগে তখন বিমান অনেক বড় দল। অনেক তারার দল। ফারুক, আতহার, শাহিন, রুপম, খালেদ মাহমুদ সুজন ও হাসানুজ্জামানরা (ঝড়ু) খেলেন। এতগুলো নামি পারফরমার ও বড় তারকাদের সাথে প্রথম বছর প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পাবার স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বলে- আমি খুলনার হয়ে জাতীয় লিগে ভাল বল করেছিলাম। আর হাসানুজ্জামান ঝড়ু ভাই আমার ডিভিশন খুলনা দলে ছিলেন। বলতে পারেন, তার হাত ধরেই বিমানে যাওয়া এবং ফারুক ভাই ও আলী আহসান বাবু ভাইয়ের নজরে পড়ে মোহামেডানের মত ঐতিহ্যবাহী এবং কাগজে কলমের অন্যতম শীর্ষ দলের বিপক্ষে প্রথম খেলতে নামার আগে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমার মনে হয় আমি সে ম্যাচে ভাল বল করেছিলাম।’

রাজ্জাক যে মোহামেডানের বিপক্ষে ১৮ বছর আগে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভাল বল করেছিলেন, তার বলে রান করার একটু হলেও কঠিন ছিল। তা এখনো ভালই মনে আছে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর। স্মৃতি হাতড়ে তা খুঁজে নান্নুর স্বীকারোক্তি, ‘হ্যাঁ রাজ খুব জোরের ওপর সোজা ডেলিভারি (আর্মার) ছুঁড়ছিল। আর তখনকার উইকেটের বাউন্স ছিল এখনকার চেয়েও কম। তাই রান করতে সমস্যাই হচ্ছিল।’

বাংলাদেশের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা যারা আশির দশক থেকে একদম খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং এখনো দেখছেন- তাদের সবার জানা স্পিনের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কুশলী ও দক্ষ উইলোবাজের নাম মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। বলের বাঁক দেখে-বুঝে ফিল্ডারের নাগালের বাইরে বল ঠেলায় জুড়ি ছিল না নান্নুর। স্ট্যান্স থেকে শুরু করে ফুটওয়ার্ক এবং টেকনিকের আলোকে আমিনুল ইসলাম বুলবুলও অসাধারণ। ব্যাকরণসিদ্ধ এবং প্রথাগত ব্যাটসম্যানের কার্বন কপি। স্পিনে তার ফুটওয়ার্কও ছিল দারুণ। ‘ডান্সিং ডাউন দ্য উইকেট’- এক দু’পা সামনে বেড়িয়ে এসে স্পিনের মুখে উইকেটের সামনে কভার, মিড অফ, মিড অনে খেলতে দারুন সিদ্ধহস্ত ছিলেন বুলবুল। সেই নান্নু আর বুলবুলের মত বড় মাপের ব্যাটসম্যানদের যিনি ক্যারিয়ারের আর্মার আর ভাল জায়গায় বল ফেলে খানিক বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন, সেই বাঁ-হাতি স্পিনার দেশের ক্রিকেটে লিস্ট ‘এ’তে প্রথম ৪০০ উইকেট শিকারি- সেটাই তো স্বাভাবিক। এটাই রাজ্জাকের বড় প্রাপ্তি। তারপর মনে অনেক কষ্ট, যন্ত্রনা। সে দুঃখ-কষ্টের ঘা শুকোয়নি। হয়ত শুকাবেও না।

আর তাইতো ৪০০ উইকেট শিকারের আনন্দের মাঝেও মুখে সে মনোকষ্টের কথা, ‘আসলে দুঃখের কথা কি বলবো? কাকে দুষবো? আমার কারো বিপক্ষে কোন অভিযোগ নেই। তবে একটা বড় দুঃখবোধ আছে। তাহলো, আমি যখন পরিণত হয়েছি, যখন প্রথম মনে হলো, আমি কি? আমার সীমাবদ্ধতা কোথায়? আমার শক্তি ও সামর্থ্যের জায়গাটাই বা কি? কখন কোথায় কি করতে হবে- ঠিক তখনই ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো। আমি বাদ পড়লাম। এটা যে কত বড় মানসিক যন্ত্রনা, বলে বোঝাতে পারবো না! আমার আর কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। তবে আমি চেয়েছিলাম এমন কিছু করে যাই, তাতে সবাই আমাকে মনে রাখবে।’

আর কতদিন খেলতে চান রাজ্জাক? তার শেষ কথা, ‘যতদিন ক্রিকেটটা উপভোগ করবো ততদিন মাঠে থাকার ইচ্ছে আছে। এখনকার মত যতদিন প্র্যাকটিসে যেতে মন চাইবে, অনুশীলন ও ম্যাচ খেলার জন্য আগের মত ভোরে উঠতে পারবো, এতটুকু আলস্য আসবে না এবং শরীর ও মন বাঁধা হয়ে দাড়াবে না- ততদিন খেলে যাব।’

এআরবি/আইএইচএস/এমকেএইচ