একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ৫০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। ওই রাতে একযোগে পাকসেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় তখনকার ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলাসহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
Advertisement
সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো শুধুই লাশ। যেন হত্যার মহোৎসব শুরু করে পাক বাহিনী বাঙালি নিধনের মধ্য দিয়ে। সেই কালো রাত থেকেই শুরু হয় হত্যা। মার্চ থেকে ডিসেম্বর- নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে তারা। কিন্তু বাঙালি জাতি সেই হত্যাযজ্ঞে থেমে থাকে নিদর্শক হয়ে থাকেনি কিংবা পলায়ন করেনি, গর্ত খোঁজেনি লুকিয়ে থাকার। গণহত্যা শুরুর পর থেকেই বীর বাঙালি প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে।
পাকিস্তানী বাহিনী অকাতরে মানুষ মেরেছে, নারীদের সম্ভ্রম হরণ করেছে। পৃথিবীর জগন্যতম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে ওরা। শুরু করে তারা গণহত্যা। বাঙালিদের রক্তে সারা দেশটাই রঞ্জিত হতে থাকে সেই থেকে।
পাকিস্তানী বাহিনীর সেই গণহত্যার নতুন তথ্য এসেছে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের জরিপে। জরিপ অনুযায়ী, ২০ জেলায় ৫ হাজার ১২১টি গণহত্যা ঘটেছে। বধ্যভূমির সংখ্যা ৪০৪, গণকবর ৫০২ ও নির্যাতন কেন্দ্র ৫৪৭টি। প্রতিটি গণহত্যায় ৫ থেকে ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
Advertisement
আবার চুকনগরে একটি গণহত্যায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। এর আগে গত বছর মার্চে অন্য ১০টি জেলার জরিপের ফল প্রকাশ করেছিল সংগঠনটি। তখন জানানো হয়েছিল, নীলফামারী, বগুড়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, পাবনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, ভোলা ও খুলনা জেলায় মোট এক হাজার ৭৫২টি গণহত্যার ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।
২৫ মার্চের মত বিশ্বের কোথাও এক দিনে এত বড় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। অথচ পাকিস্তানীদের এই বর্বরতার চিত্র কি যথার্থ গুরুত্ব পেয়েছে এমনকি আমাদেরও ইতিহাসের পাতায়, সে প্রশ্নটা আজ উচ্চারিত হচ্ছে। গবেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; গণহত্যা এবং মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
বিজয় আমাদের অর্জন, কিন্তু এ অর্জনের মাঝে জড়িয়ে আছে আমাদের শত সহস্র পরিবারের বুকফাটা আর্তনাদ। এখনও নীরব কান্নায় আর হাহাকারের মধ্য দিয়ে শত শত মা-বাবা প্রহর গুনেন তার সন্তানের। বীরাঙ্গনার চাপাকান্না আর দীর্ঘশ্বাসে বাংলাদেশের দিগন্ত এখনও নীল হয়। গলা-কাটা মোরগের মতো আমাদের বীরাঙ্গনারা এখনও যেন জীবন্মৃত হয়ে ভেসে বেড়ান সারা বাংলায়।
পাকিস্তানী বর্বরদের দ্বারা লাখ লাখ মানুষের গণহত্যার মধ্য দিয়েই আমাদের বিজয়, আমাদের অর্জন। মানুষের এই যে আত্নত্যাগ কিংবা বিসর্জন, ইতিহাসের পাতায় তার স্বীকৃতি আসা প্রয়োজন শুধু আমাদের পূর্বপুরুষদের বিসর্জনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই নয়, বরং আগামীর পৃথিবীতেও মানুষ জেনে রাখুক কি পাষণ্ড রক্তশোষকরা হত্যায় মেতে উঠেছিলো বাংলাদেশের মানুষের উপর।
Advertisement
এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে গণহত্যার ভয়াবহতা প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানুক আর ঘৃণা করুক একাত্তরের সেই পরাজিত হত্যাকারীদের। স্বীকৃতি সেজন্যই প্রয়োজন, আর সেজন্যই গণহত্যা নিয়ে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। আর তা নাহলে আমাদের বিজয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ যে আত্মত্যাগ করেছিল এই প্রসঙ্গটিও আড়ালে পড়ে যাবে।
বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এ নিয়ে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ' নামে একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অথচ দেখা গেছে, ৯০ এর দিকে যখন জাতিসংঘে তথা আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় তখন বাংলাদেশের জেনোসাইড বাদ দিয়ে রুয়ান্ডা-যুগোশ্লাভিয়ার কথা উঠে এসেছে। সেকারণে জেনোসাইড কনভেনশনে বাংলাদেশের গুরুত্ব কমে যায়। আর তাই বাংলাদেশের এই ভয়াল রাতটা আন্তর্জাতিকভাবে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতির পর্যায়ে যায় নি।
আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, সিয়েরা লিওন ও বসনিয়ায় গনহত্যা সংঘঠিত হয়েছে। এগুলো বিশ্বে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। অথচ ২৫ শে মার্চের রাত বাংলাদেশে উচ্চারিত একটা রক্তমাখা কালো রাত। বাংলাদেশের এই গণহত্যায় আমরা হারিয়েছি হাজারো লাখো লাখো মানুষ। আমাদের স্বজনহারানোর এই দুঃখগাথা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বীকৃতির বাইরে থাকবেই বা কেন।
সেকারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোর মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাড়তি উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ কম হচ্ছে না। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে একটু বাড়তি আগ্রহও আছে। বাংলাদেশরে বিজয় নিয়ে যতটুকু আলোচনা কিংবা যেভাবে উৎসবে মেতে উঠে রাষ্ট্র কিংবা আমাদের গোটা জাতি, সে হিসেবে আমাদের বিসর্জন কিংবা ত্যাগকে কতটুকু সামনে নিয়ে আসছি আমরা।
রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের যতটুকু চিহ্নিত করছি, সামনে নিয়ে আসছি তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন এদের যোগসাজশে পাকিস্তানীদের দ্বারা নিহত বাঙালিদের গণহত্যার চিত্র সামনে নিয়ে আসা। আজ গণহত্যা দিবস নিয়ে আলোচনা চলছে, কিন্তু গণহত্যা দিবসটিকেও আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাঝে এনেছি মাত্র দুবছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে।
এই দুবছরের মধ্যেই এটাকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়। এছাড়া ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা বিষয়ক একটা দিবস হিসেবে ইতিমধ্যে জাতিসংঘ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে । অন্যদিকে ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ যেদিন ৯ ডিসেম্বরকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে সেদিন বাংলাদেশও সে অধিবেশনে উপস্থিত ছিল। কিন্তু কোনো ভেটো দেয়নি, একবারও বলেনি, গণহত্যা দিবস হওয়া উচিত ২৫ মার্চ।
অথচ বিশ্বের কোথাও এক দিনে এত বড় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি। স্মরণকালের ইতিহাসের নৃশংসতম ঘৃ্ণ্য যে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়াটা খুবই যৌক্তিক, আর সেজন্যেই সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যা বিষয়ক দিবস থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে ২৫শে মার্চকে গণহত্যা দিবস করা যাবে কি-না এ নিয়ে অনেকেই সন্ধিহান।
জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা দিবস পরিবর্তন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবুও বলা যায়, বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চকে সামনে রেখে ৯ মাসের ‘গণহত্যার স্বীকৃতি’ আদায় করে নেয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করতেই পারে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের মিশনগুলো এতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেই পারে। সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রণয়ন করতে পারে। ২০১৯ এ অন্তত এ কাজটা শুরু হোক।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম