ভ্রমণ

কম সময়ে ঘুরে আসুন রেমা-কালেঙ্গা বন

সুন্দরবনের পর দেশের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চল হচ্ছে রেমা-কালেঙ্গা। শুধু তা-ই নয়, দেশের যে কয়টি স্থানে বন্যপ্রাণির অবস্থা ভালো; তার একটি এই চিরহরিৎ বন। ভ্রমণপিপাসুর অনুভূতি অন্যসব জায়গায় ভ্রমণের চেয়ে এখানে আলাদা। চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন কম সময়ে।

Advertisement

অঞ্চলটি রেমা, কালেঙ্গা, ছনবাড়ি ও রশিদপুর- চারটি বিটে ভাগ করা। ১,৭৯৫ হেক্টর জায়গার এ বনে বর্তমানে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। অনেক বিরল প্রজাতির পাখির জন্য এ বন সুপরিচিত। এরমধ্যে রয়েছে শকুন, মথুরা, বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল, কাও ধনেশ, ফোটা কান্টি সাতভারলা, শ্যামা, শালিক, শামুক খাওরি, টুনটুনি প্রকৃতি।

বনে উল্টোলেজি বানর, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী প্রজাতির বানরের বাস। তাছাড়া এখানে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখা যায়। একটু খেয়াল করলেই হরেক রকমের প্রাণির দেখা পাবেন। ভিন্ন এক জগতের আবহ ভেসে উঠবে চোখের সামনে। বনের ভেতর ১৪-১৫টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর পাড়া রয়েছে। বনের ভেতরেই দেখতে পাবেন ধানের বিস্তর সবুজ মাঠ।

একদিনের ট্যুরে আমরা ১৮ জন ঘুরে এলাম সেই রেমা-কালেঙ্গা। রেমা ও কালেঙ্গা দুটো আলাদা স্থানের নাম বোঝালেও আসলে এগুলোকে বনে ঢোকার দুটো প্রান্ত বলা যায়। রেমা বা কালেঙ্গার যে কোন একপাশ দিয়ে বনে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা যাবে। আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম কালেঙ্গা হয়ে ঢুকব, রেমা হয়ে বের হব।

Advertisement

> আরও পড়ুন- ছেড়া দ্বীপে নীল-সবুজের হাতছানি

এখানে পর্যটকদের জন্য ট্রেইল ৩টি। আধঘণ্টা, একঘণ্টা, তিন ঘণ্টা ও পাঁচ ঘণ্টার ট্রেইল আছে। এসব ট্রেইল থেকে যে কোনটি বেছে নিতে পারেন। তবে ৩ ঘণ্টার যে ট্রেইলটি বলা হয়ে থাকে গাইডের কথামতো, তা ৫ ঘণ্টায় শেষ হয়। যদিও আমাদের ৫ ঘণ্টার ট্রেইলে সময় লেগেছিল ৯ ঘণ্টা। কারণ হাঁটার ক্ষেত্রে আমাদের দলের অনেকেই অভিজ্ঞ ছিলেন না। তবে গাইড ছাড়া এ বনের ভেতরে প্রবেশের চিন্তাও করবেন না। কারণ বনের ভেতরে অনেক সময় গাইডরাই রাস্তা হারিয়ে ফেলে।

রেমা-কালেঙ্গা যেতে হলে দেশের যে কোন জায়গা থেকে বাসে বা ট্রেনে চলে যাবেন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। সেখান থেকে অটোরিকশায় যেতে হবে চুনারুঘাট। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৪০ টাকা। চুনারুঘাট নেমে কালেঙ্গার সিএনজিতে উঠবেন, জনপ্রতি ভাড়া নেবে ৫০ টাকা।

আমাদের একটি দল আগের দিন বিকেলেই কালেঙ্গা পৌঁছে যায়। অন্য দলটি সারারাত জার্নি করে পরের দিন সকালে পৌঁছায়। কালেঙ্গায় বনবিভাগের এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে গেস্ট হাউস আছে। ভাড়া ১ হাজারের মধ্যে। দুটি টিম একসাথে মিলে সকাল নয়টায় বনের ভেতর ট্রেইল শুরু করলাম। কালেঙ্গা থেকে রেমা হয়ে আসামপাড়া আসব, এটাই আমাদের প্লান। আগেই গাইড ঠিক করে রেখেছিলাম। তিনি বনবিভাগের অনুমোদনপ্রাপ্ত গাইড। দেড় থেকে ২ হাজার টাকার ভেতরে গাইড পেয়ে যাবেন।

Advertisement

সকাল ৯টায় কালেঙ্গা বন দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পাহাড়ি ঝিরিপথ, ছোট ছোট ছড়া, নানা জাতের উদ্ভিদ আর প্রাণি দেখতে দেখতে বিকেল ৫টার দিকে রেমা থেকে বের হলাম। বের হয়ে চা বাগানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে খোয়াই নদী পেরিয়ে অটোরিকশায় যখন চুনারুঘাটের আসামপাড়ায় এলাম, তখন দিনের আলো হারিয়ে সন্ধ্যা।

> আরও পড়ুন- সিলেট ভ্রমণের আগে যে বিষয়গুলো জেনে নেবেন

বনের যে জায়গাগুলো খানিকটা ফাঁকা, গাছ কিছুটা কম, সূর্যের আলো মিলে সেসব জায়গায় অদ্ভুত এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বনের ভেতর কিছুদূর যাওয়ার পর গাইড বললেন, ‘ওই যে বাসা থেকে উঁকি দিচ্ছে ময়না পাখি’। সবাই ছুটে এলো গাইডের কাছে। এসে ‘কই, কই, ময়না কই? কই ভাই?’ বলতেই সবার আওয়াজ পেয়ে ময়না উড়ে চলে গেল। ফলে কেউ ময়না পাখি দেখতে পেল, কেউ পেল না। তাই বন্যপ্রাণি দেখতে হলে যত শব্দ কম, তত কাছ থেকে দেখা যাবে। এরপর দূর থেকে কিছু রঙিন পাখি, হনুমান আর ব্যাক কাঠবিড়ালি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। বনের ভেতর সুন্দর একটি লেক সৃষ্টি করা হয়েছে বন্যপ্রাণির পানির চাহিদা মেটাতে। মনোরম এ লেকের পাশেই সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে ক্লান্ত হয়ে কালেঙ্গা পেরিয়ে রেমা বনে ঢুকলাম। তখন আর আমাদের হাঁটার মতো অবস্থা নেই। অসম্ভব ঘন বনের ভেতর দিয়ে হাঁটা খুবই কষ্টকর। এদিকে সঙ্গে আনা পানিও শেষ। চারপাশে দুর্ভেদ্য বেড়ার মতো ঘন বন। বড় গাছ এখানে নেই, কেটে ফেলা হয়েছে হয়তো। হাঁটতে হাঁটতে এতটাই ক্লান্ত যে, ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলাম না। কোথাও একটু গাছের নিচে বিশ্রাম নেব, সে উপায়ও নেই। কারণ ইতোমধ্যে দলের অনেককেই জোঁকে ধরেছে। যা বনের ভেতর বসার আর সাহস দিচ্ছে না।

নানা ভয়-ক্লান্তি নিয়ে আমরা লোকালয়ে ফিরলাম। ছোট একটি ডিঙ্গি নৌকায় পার হয়ে এলাম খোয়াই নদী। আসামপাড়ায় ভাত খেয়ে যার যার বাসার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। গাইডের দেওয়া তথ্যমতে, বনের ভেতরে আমরা ১৭ কিলোমিটার হেঁটেছি এবং বনের বাইরের অংশ মিলে ২৭ কিলোমিটার। তবে অনেক ক্লান্ত হলেও অনেকদিন মনে রাখার মত একটি ভ্রমণ ছিল। এটাও মনে রাখতে হবে যে, বনে গেলে পর্যাপ্ত পানি, শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

এসইউ/জেআইএম